আইজিপির নির্দেশে অ্যাকশনে পুলিশ; ২২ মামলায় গ্রেফতার ১৩ মানবপাচারকারী

প্রকাশিতঃ 8:05 pm | June 07, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

মানবপাচার চক্রের কবলে পড়ে লিবিয়ায় ২৬ নিরীহ বাংলাদেশীর প্রাণ হারানোর পর নড়েচড়ে বসেছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ চক্রকে সমূলে উৎপাটিত করতে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.বেনজীর আহমেদের কঠোর নির্দেশে সর্বশক্তি দিয়েই মাঠে নেমেছে পুলিশ।

স্থায়ীভাবে এ চক্রকে নির্মূল করতে আদাজল খেয়েই বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট।

এ অভিযোগে দায়ের করা পৃথক ২২ টি মামলায় ইতোমধ্যেই ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব, ডিএমপি, সিআইডি, পিবিআইসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। অবৈধ মানব পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে পুলিশের এ শক্ত অবস্থান অটুট থাকবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

জানা যায়, গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানব পাচারের শিকার ২৬ নিরীহ বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা কেবল বাংলাদেশ নয়, আলোড়িত করে পুরো বিশ্বকে।

ওই ঘটনার পর তদন্তের পাশাপাশি সাঁড়াশি অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই মধ্যে লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের একের পর এক অভিযানে গ্রেফতার করা হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, ইতোমধ্যেই শতাধিক মানবপাচার চক্রের একটি তালিকা করেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এরমধ্যে কেউ ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক, কেউ দালাল চক্রের সদস্য।

ঢাকার রমনার বেইলীরোডের নুরজাহান আক্তার (৪০), আব্দুস সাত্তার (৫০), রুজভেল্ট ট্রাভেল এজেন্সির পরিচালক আকবর হোসেন এবং মগবাজার ওয়্যারলেস গেটের খালিদ চৌধুরী (৪৮) ও বনানীর বেঙ্গল টাইগার ওভারসিস লিমিটেডসহ একাধিক ট্র্যাভেল এজেন্সির নাম রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে।

সূত্র মতে, পুলিশের অন্যতম শীর্ষ ইউনিট র‌্যাব লিবিয়ায় মানবপাচার চক্রের মূল হোতা কামালকে গ্রেফতার করে লিবিয়ার ঘটনার পর পরই। গত ৩ জুন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থেকে সেন্টু শিকদার ও নার্গিস আক্তার নামে দুই মানব পাচারকারীসহ মোট ৮ জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয়।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্র জানায়, লিবিয়ায় ৩৮ বাংলাদেশিকে দুই বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করে পাচার করা হয়েছে। পাচারের এসব গ্রুপগুলো কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, বরগুনা ও ঢাকায় সক্রিয় রয়েছে।

সিআইডি আরও জানিয়েছে, বিভিন্ন এজেন্সির ও রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক, কর্মচারী ও তাদের দালালরা এসব মানবপাচার চক্রের সদস্য। তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বেকার যুবকদের টার্গেট করে সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে।

এরপর তিন-চার লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের অবৈধভাবে ইউরোপে পাঠানোর চেষ্টা করে। লিবিয়ায় তাদের নেওয়ার পর জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সাধারণত বৈধ উপায়েই বাংলাদেশীরা বিদেশে গমন করেন। বৈধ পাসপোর্ট, বৈধ ট্যুরিস্ট বা অন্যান্য ভিসায় প্রথমে ভারত বা অন্য কোনো দেশে যান।

এসব ক্ষেত্রে, উপযুক্ত ও বৈধ ট্রাভেল ডকুমেন্ট প্রদর্শন করেই তারা বাংলাদেশ ত্যাগ করে থাকেন। পরে দালাল ও পাচারকারীদের সহযোগিতায় ভারত বা সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে নানা ওপায়ে তারা লিবিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।

একই সূত্র মতে, কখনও কখনও দালালের সহযোগিতায় ভিন্ন উপায়ে সীমান্ত পাড়ি দেন কেউ কেউ। বিদেশে যাওয়ার পন্থা যাই হোক সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষ বা ব্যক্তির কাছ থেকে মানব পাচারের কোনো অভিযোগ পেলে পুলিশ যথানিয়মেই আসামী গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করে। যথা নিয়মেই তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন বিচারিক কার্যক্রমের জন্য আদালতে উপস্থাপন করেন।

একজনকেও না ছাড় দেওয়ার হুঁশিয়ারি আইজিপির
মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত একজনকেও ছাড় না দেওয়ার কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন পুলিশ প্রধান ড.বেনজীর আহমেদ, বিপিএম (বার)।

তিনি বলেছেন, ‘যারা আমাদের দেশের নাগরিকদেরকে প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে নিয়েছে, যাদের কারনে এই নির্মম মৃত্যু ঘটেছে তাদের একজনকেও ছাড় দেওয়া হবে না।

তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে এই চক্রের প্রত্যেক সদস্যকে আইনী প্রক্রিয়ায় কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। যাতে করে ভবিষ্যতে কোনো বাংলাদেশীকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে, তার জীবন নিয়ে খেলার দু:সাহস কোনো মানুষ দেখাতে না পারে। দেশে ও বিদেশে যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেনো তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করা হবে।

গত সোমবার (০১ জুন) পুলিশ সদর দপ্তরে এক জরুরি ভিডিও কনফারেন্সে তিনি এসব কথা বলেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো.সোহেল রানা। এই ভিডিও কনফারেন্সে পুলিশের সব ইউনিট প্রধানসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন।

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যাকান্ডের ঘটনাটিকে অত্যন্ত মর্মান্তিক উল্লেখ করে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড.বেনজীর আহমেদ বলেন, যেভাবে আমাদের দেশের মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। স্বজনদেরকে যারা ভাই বোন পিতা মাতা হারা করেছে তাদের কোনো ক্ষমা নেই।

জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করে আইজিপি বলেন, ‘স্বজনদের কান্নার দাগ শুকানোর আগেই, এই অপরাধী চক্রকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

নিজ বাহিনীর দায়িত্বশীলদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পর আমি দ্বিতীয়বার তোমাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো, এর আগে নয়।’

প্রধানমন্ত্রীর মোহনীয় নেতৃত্বে বাংলাদেশ আত্মমর্যাদায় বলীয়ান
পুলিশ মহাপরিদর্শক জরুরি ভিভিও কনফারেন্সে স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আমাদের দেশের মানুষকে এভাবে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে, সেই অবস্থানে এখন বাংলাদেশ নেই। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্যাগী ও মোহনীয় নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ আত্নমর্যাদায় বলীয়ান এক অন্য বাংলাদেশ।’

তিনি বলেন, ‘অর্থ উপার্জন ও জীবিকার জন্য দুর্গম ও অবৈধ পথে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমানোর কোনো কারণই নেই। এই বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের একটি উন্নয়নশীল দেশ। অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছি আমরা।’

কালের আলো/এসআর/এমসি