সিন্ডিকেটের খপ্পরে বাঁধার মুখে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্প
প্রকাশিতঃ 9:50 am | June 23, 2020
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
পর্যটনের স্বর্গভূমি বলা হয় কক্সবাজারকে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের এ শহরের বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দরটির রানওয়ে ৯ হাজার বর্গফুট থেকে ১২ হাজার বর্গফুটে উন্নীত করতে আহ্বান করা হয় দরপত্র।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন মেনেই দরপত্র চূড়ান্ত করে। সিভিল এভিয়েশন পোস্ট কোয়ালিফেকশনের মাধ্যমেই সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে যে কোম্পানিটিকে নির্বাচন করেছে সেটি দরপত্রে দেওয়া বাজেট থেকে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা কম দর দিয়েছে।
কিন্তু অভিযোগের ফাঁদ পেতে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পটি বাঁধাগ্রস্ত করতে কূটকৌশলী আচরণ শুরু করেছে চিহ্নিত একটি সিন্ডিকেট। নিজের মিশন বাস্তবায়নে ভুল তথ্যে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দাখিল করছেন।
কিন্তু কোন সুবিধা করতে না পেরে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন অপকৌশল গ্রহণ করছেন। এভিয়েশন খাতে শক্ত সেই সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ জমেছে সম্প্রসারিত গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটির ভাগ্যাকাশে।
জানা যায়, একটি আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দরের আদর্শ রানওয়ে ধরা হয় সাড়ে ১০ হাজার ফিট। কিন্তু সেই হিসেবে মোটেও আদর্শিক নয় কক্সবাজার বিমানবন্দরটির রানওয়ে। এ বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই আন্তরিক।
তিনিই এ বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীতকরণে কার্যকর নির্দেশ প্রদান করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে।
২০১৫ সালের ২ জুলাই কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধাানমন্ত্রী। ওই সময় বিমানবন্দরের রানওয়ে ৬ হাজার ৭৭৫ ফুট থেকে বাড়িয়ে ৯ হাজার ফুটে উন্নীত করা করা হয়।
সূত্র মতে, শুরুর দিকে এ বিমানবন্দরের প্রকল্প পরিচালকের সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অযোগ্যতায় প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। পরবর্তীতে শত কোটি টাকা অপচয় করায় ওই প্রকল্প পরিচালককে বরখাস্ত করা হয়।
একই সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবেশী বন্ধু মিয়ানমারের সঙ্গে নানা হিসাব-নিকাশে কক্সবাজার বিমানবন্দরটির বাড়তি তাৎপর্য রয়েছে। সামরিক কৌশলগত কারণেও আলাদা গুরুত্ব রয়েছে এ বিমানবন্দরের।
আবার দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিবেচনায় কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের উন্নীতকরণের পাশাপাশি বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণও পুনরায় অপরিহার্য হয়ে উঠে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সব সময় কক্সবাজারে থাকে বিদেশি পর্যটকের ঢল। কিন্তু পর্যটকরা ঢাকা হয়ে কক্সবাজারে আসেন। ফলে অনেক সময় বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের।
এসব বিবেচনা করেই আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করার উদ্যো গ্রহণ করা হয়। এ কার্যক্রম সম্পন্ন হলে পর্যটকদের আর ঢাকা হয়ে কক্সবাজারে আসতে হবে না।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার বিমানবন্দরটির রানওয়ে ১২ হাজার ৫’শ ফুটে উন্নীত করার নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। পরবর্তীতে এটি ১০ হাজার ৭’শ ফুটে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সেই মোতাবেক সম্প্রতি কক্সবাজার বিমানবন্দরটির রানওয়ে আরও এক হাজার ৭০০ বর্গফুট বাড়াতে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
নিয়ম মোতাবেক বেবিচকের আহ্বানকৃত দরপত্রে বুয়েটের স্বনামধন্য শিক্ষকরা কারিগরি মূল্যায়নে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু দরপত্রটি প্রশ্নবিদ্ধ করতে গোয়েবলসীয় কায়দায় অভিযোগের তুবড়ি ছুটাতে শুরু করে একটি সিন্ডিকেট।
নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা একটি কোম্পানিকে ব্যবহার করে সিভিল এভিয়েশনে ভুল তথ্যে অভিযোগও দাখিল করেন।
এরপর সিভিল এভিয়েশন পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন (পিপিআর) ২০০৮’র বিধি-৮ মোতাবেক সেই অভিযোগের যথাযথ জবাব প্রদান করেন। পরবর্তীতে ওই কোম্পানিটি মন্ত্রণালয় বা সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) আর কোন অভিযোগ করেনি।
সূত্র মতে, বৃহৎ এ প্রকল্প কাজের দরপত্রে ৮ টি কোম্পানি অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান রেসপন্সিভ হয়েছে। এখানে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন (পিপিএ) ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন (পিপিআর) ২০০৮’র বিধি-৮ অমান্যের ঘটনাও ঘটেনি।
দরপত্র থেকে ছিটকে পড়া পক্ষটি পোস্ট কোয়ালিফিকেশন ছাড়াই সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচন করার অভিযোগ করেন। অথচ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন (পিপিআর) মোতাবেকই পোস্ট কোয়ালিফিকেশন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বেবিচকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র।
সূত্র মতে, দরপত্র মূল্যায়ন শর্ত মতেই দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারদের অভিজ্ঞতা নূন্যতম ১৫ বছর থাকতে হয়। আর দরপত্রের কার্যাদেশ পাওয়া কোম্পানিটি ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সেই হিসেবে কোম্পানিটির অভিজ্ঞতার বয়স ৩১ বছর। ২০১১ সালের জুন মাসের দিকে কোম্পানিটির নাম পরিবর্তিত হয়। কাজেই তাদের অভিজ্ঞতা দরপত্রের শর্তের চেয়েও বেশি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলছেন, ‘সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) ধারায় নাম দেওয়া থাকে কোন কোন কোম্পানি দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
অর্থাৎ, কালো তালিকাভূক্ত কোম্পানিসমূহের নাম সিপিটিইউতে অন্তর্ভূক্ত থাকে। কিন্তু সিপিটিউতে কালো তালিকাভুক্ত ৯৫ কোম্পানির মধ্যে কার্যাদেশ পাওয়া এ কোম্পানির নাম নেই।’
অবশ্য কেউ কেউ বলাবলি করছেন, করোনার অজুহাত দেখিয়ে দরদাতার দাখিলকৃত দলিলপত্র যাচাই-বাছাই না করেই চূড়ান্ত করা হয়েছে, এমনকি দরদাতার টার্নওভারসংক্রান্ত ব্যাংকের ডকুমেন্টও দেখা হয়নি। কিন্তু এমন অভিযোগেরও কোন ভিত্তি মেলেনি।
বেবিচক সূত্র বলছে, দরপত্রে অংশগ্রহণ করা কোম্পানিসমূহ সেই দেশের বাংলাদেশী দূতাবাসের মাধ্যমে সত্যায়িত হয়েছে। ব্যাংক থেকেই সব তথ্য নিয়েই দলিলপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।
চীনের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের অভিজ্ঞতার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও কোন ফাঁক-ফোকরের সুযোগ রাখা হয়নি।
সূত্র মতে, একটি সিন্ডিকেট সিভিল এভিয়েশনের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে উন্নয়ন কাজে স্থবিরতা তৈরির টার্গেট করেছে। প্রথম দিকে তারাই প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে (সিএইচইসি) কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া না গেলেও নিজেরা কাজ ভাগিয়ে নিতেই নানামুখী অপকৌশল বাস্তবায়নে মরিয়া চিহ্নিত এ চক্রটি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান কালের আলোকে বলেন, ‘স্বচ্ছভাবে সব প্রক্রিয়া মেনেই ওই কোম্পানিকে কাজের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে।’
জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো.মাহবুব আলী কালের আলোকে বলেন, ‘সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবেই ওই কোম্পানি কাজটি পেয়েছে। এখানে কোন অনিয়মের প্রশ্নই উঠে না। পুরো কার্যক্রমেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে।’
কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে