দুর্নীতির মূলোৎপাটনে দুদকের ‘টিম ওয়ার্ক’, জনমনে ফিরেছে আস্থা
প্রকাশিতঃ 11:09 am | June 27, 2020
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
‘দুর্নীতিবাজ যে-ই হোক, ছাড় নেই। দুর্নীতি করলে দুদকের বারান্দায় আসতেই হবে’-সব সময়ই বলছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। দুর্নীতির কালোপাহাড়ের বিরুদ্ধে তার শক্ত অবস্থান। তিনি বিশ্বাস করেন, সাধারণ মানুষের দুর্নীতিবিরোধী সমন্বিত কন্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিতে পারে দুর্নীতিকে।
উন্নয়নের মহাসড়কে পথচলা দেশটিতে দুর্নীতি দমনকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন কমিশন হিসেবেই অহর্নিশ কাজ করছে দুদক। এক সময় ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বলে পরিহাসের শিকার দুদক এখন যে কোনো দুর্নীতির বিরুদ্ধেই সক্রিয়, তৎপর এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে পারঙ্গম।
জনসম্মুখে নিজেদের এমন সব কর্মকান্ডের মাধ্যমেই কমিশন থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে নখদন্তহীন বাঘের জামানা। দুদক কমিশনার ড.মোজাম্মেল হক খানের ভাষ্যে-‘দুদকের কামড় দেয়ার প্রয়োজন হয় না। দুদকের আচড় লাগলেও অনেকে সহ্য করতে পারে না।’
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিআরটিএ, রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ ১৫ টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে সুপারিশমালা হস্তান্তর থেকে শুরু করে ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার মূল হোতা মাহবুবুল হক চিশতী, বালিশ আর পর্দাকাণ্ডের মতো দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্তদেরও ছাড় হয়নি নূন্যতম।
স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি বন্ধে দুদকের সুপারিশ ডিপ ফ্রিজবন্দি না হলে করোনায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে সিন্ডিকেটের বেপরোয়া বাণিজ্যের ভয়ঙ্কর অকল্পনীয় দৃশ্য দেশবাসীকে দেখতে হতো না মোটেও।
ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে স্বাধীন এ প্রতিষ্ঠান।
বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির হোতাদের ধরতে জোর তৎপরতা শুরু করেছে। অনুসন্ধানের জন্য গঠিত হয়েছে চার সদস্যের কমিটি। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালককে। পুরোমাত্রায় কাজও শুরু হয়ে গেছে।
এমন সক্রিয় সব পদক্ষেপের পাশাপাশি জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে অভিযান, অনুসন্ধান, গণশুনানির আয়োজন, ফাঁদ মামলা ছাড়াও সততা সংঘ ও সততা স্টোরের মাধ্যমে শিশুদের উত্তম চর্চার বিকাশ, দুর্নীতির মূলোৎপাটনেের চেষ্টা, মামলায় সাজার হার বাড়ানোসহ ইত্যাকার বিষয়ে ‘টিম ওয়ার্ক’ চালিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
সূত্রের ভাষ্যমতে, দুর্নীতির মতো জটিল বিষয় অনুসন্ধান ও তদন্ত করে অভিযুক্তকে বিচারের মুখোমুখি করতে সংস্থাটির সক্ষমতার অভাব দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ, লোকবলসহ সব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অনন্য ‘টিম দুদক’
দুদক প্রতিনিয়তই দুর্নীতিবাজদের শক্ত ঝাঁকুনি দিচ্ছে। দুর্নীতি দমনে ইতিবাচক অগ্রগতির বার্তা দিচ্ছে সংস্থাটির দায়ের করা মামলায় বিচারিক আদালতে সাজার হারের মাধ্যমে।
সূত্রের তথ্য মোতাবেক, নিজেদের দায়ের করা মামলায় বিচারিক আদালতে সাজার হার প্রায় ৭০ শতাংশ আর উচ্চ আদালতে ৫৩ শতাংশের বেশি।
টিম দুদকের ‘অধিনায়ক’ হিসেবে রয়েছেন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। দুদকের দায়িত্ব নেওয়ার আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে তিনি অবসরে যান।
‘ডেপুটি কাপ্তান’ হিসেবে তাকে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন কমিশনার (অনুসন্ধান) ড.মো: মোজাম্মেল হক খান ও কমিশনার (তদন্ত) এ এফ এম আমিনুল ইসলাম।
দুই কমিশনারের একজন মোজাম্মেল হক খান নিজেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ছিলেন। সামলেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও।
সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ছিলেন আমিনুল ইসলাম। মেধা, মননে, জ্ঞানে গরিমায় তারা প্রত্যেকেই অনন্য।
এ টিমে অগ্রভাগেই রয়েছেন কমিশনের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখতও। এখানে যোগদানের আগে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামো বিভাগের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, সম্মিলিত প্রয়াসেই সৃজনশীল নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও দুর্নীতি প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে। দুদককে শক্তিশালীভাবে গড়ে তুলতে নতুন করে ঢেলে সাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই জনমনে থাকা প্রশ্নও কাটিয়ে উঠতে নিজেদের সক্ষমতার কথা জানান দিতে পেরেছে সংস্থাটি।
এতে দুদকের প্রতি প্রতিনিয়তই আস্থা বাড়ছে সাধারণ মানুষের। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের মাধ্যমে কার্যকর, ফলপ্রসূ ও টেকসই অবদান রাখতেও নিরবচ্ছিন্ন কাজের মাধ্যমেই ক্রমবর্ধমান সাফল্য ধরে রাখতে চায় দুদক।
জনমুখী দুদক, একগুচ্ছ কার্যক্রম কমিশনের
চাকরি জীবনে ডাক ও টেলিযোগাযোগ, সড়ক ও রেলপথ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ছিলেন ইকবাল মাহমুদ।
২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি দুদক চেয়ারম্যান দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শুরু থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বার্তা দেন।
দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে বহুমুখী কর্মতৎপরতা বাড়িয়ে দেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলারও আহ্বান জানাচ্ছেন।
ফাঁদ মামলার মাধ্যমে সরকারি অফিসে ঘুষের লেনদেন কমিয়ে আনার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কমিশনের তদন্ত ও প্রসিকিউশনের সক্ষমতা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে কাজ করছেন।
দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরদের সক্ষমতা বাড়াতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) সংক্রান্ত অপরাধে দুদকের দায়ের করা মামলায় সাজার হার শতভাগ।
সূত্র মতে, দুদকের উদ্যোগে গণশুনানিতে জোর দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী পরিচালিত হচ্ছে এ গণশুনানি কার্যক্রম।
দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধে দেশজুড়ে রেকর্ড গণশুনানির আয়োজনের মাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সব কন্ঠস্বরকে একত্রিত করার মাধ্যমে জনমুখী হয়েছে দুদক। এখানে প্রতিটি সরকারি সেবা কার্যক্রমের হালহকিকত উঠে আসছে ভুক্তভোগীদের বক্তব্যে।
গণশুনানিতে অংশ নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেমন কণ্ঠ উচ্চকিত করতে পারছেন তেমনি সরকারি কর্মকর্তাদেরও দায়বদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত মানসম্মত সেবা প্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ।
একই সূত্র জানায়, মামলায় সাজার হারও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে দুদকে। যেকোনো ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কমিশনের গোয়েন্দা ইউনিটের তৎপরতাও বেড়েছে।
কমিশনের জনসংযোগ বিভাগ নিয়মিতই দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি ইস্যুতেই কথা বলছেন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।
দুদক চেয়ারম্যান মনে করেন, ‘ছোট ছোট দুর্নীতি যা অঙ্কুরেই বিনাশ করা গেলে, বড় বড় দুর্নীতির পথ সঙ্কুচিত হয়ে আসে। তা না হলে এই ছোট ছোট দুর্নীতি এক সময় দুর্নীতির মহিরুহে পরিণত হয়, যা সমাজকে বিপন্ন করে ফেলে এবং তা উপরে ফেলাও দুরূহ।’
দুদক চেয়ারম্যানের বিষয়ে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে ‘যা বলেন, তাই করেন’। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা স্পষ্টবাদী একজন মানুষ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনপ্রত্যাশাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন যিনি
সূত্রমতে, আগের চেয়ে দ্বিগুণ সাংগঠনিক কাঠামো নিয়েছে দুদক। শিশুদের মাঝে সততা ও নৈতিকতা চর্চার বিকাশে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের ২৮ হাজার ১’শ ৮৩টি স্কুল-কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে সততা সংঘ গঠন করা হয়েছে।
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের অংশ হিসেবে দেশের ৩ হাজার ৬৫৯ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিচালিত হচ্ছে সততা স্টোর। খাতা, কলম, পেন্সিলসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ মিলছে এসব স্টোরে।
তবে এজন্য কোনো বিক্রেতা নেই। শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে পণ্যের নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করছে।
কমিশন সূত্র জানায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে সৎ, মর্যাদাবান এবং চারত্রিক দৃঢ়তা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে দেশজুড়ে ৫৪১টি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছে দুদক। কমিশনে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর জন্য অনেক আগেই চালু করা হয়েছে টোল ফ্রি হটলাইন-১০৬।
এ হটলাইনের বিষয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ছে প্রতিনিয়তই। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভিযোগ এবং বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়মের কথা সরাসরি জানতে নতুন হটলাইন (+ ৮৮০১৭১৬-৪৬৩২৭৬) চালু করেছে।
ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি এবং টিআর-কাবিখাসহ সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি লুটপাটের অভিযোগে চট্টগ্রাম-১২ আসনের এমপি সামশুল হক চৌধুরী, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের এমপি আফজাল হোসেন, সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের এমপি নজরুল ইসলাম বাবু এবং ভোলা-৩ আসনের এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জানা যায়, দুদকের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি)। ২০১৭ সালের জুনে দুদক কার্যালয়ে দুদকের সঙ্গে ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দুদকের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘দুদক কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কিছু কার্যক্রমের ফলে কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা যেমন বেড়েছে। তেমনি প্রত্যাশাও বেড়েছে। তাই সবার উচিত কমিশনের পাশে দাঁড়ানো। যার যার অবস্থান থেকে দুদককে সাহায্য করতে হবে।’
দেশপ্রেমই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকার
ড.মোজাম্মেল হক খান দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) হিসেবে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে যোগ দেওয়ার পর স্বাধীন এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে আরও গতি বাড়ে। প্রশাসন ক্যাডারে স্বনামে খ্যাত ছিলেন ড.মোজাম্মেল।
ছাত্রজীবনে স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন। প্রশাসনের একজন দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবেই আরও গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পদের যেকোনো একটিতে তাঁর পদায়ন হতো পারতো। কিন্তু দুদক কমিশনার হিসেবে আরও মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বই পালন করছেন।
দুদকে চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব নিয়েই করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলা চষে বেড়িয়েছেন ড.মোজাম্মেল। দুদক ও দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির আয়োজনে গণশুনানিতে যোগ দিচ্ছেন।
এসব গণশুনানির মাধ্যমে সরকারি সেবা প্রদানে কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রিতা এবং হয়রানি সহ্য না করার হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
দুর্নীতি এবং দীর্ঘসূত্রিতা মুক্ত থেকে সরকারি পরিষেবা প্রদান করা সরকারি কর্মকর্তাদের আইনি দায়িত্ব বলেও মত দিয়েছেন। আবার, সাধারণ মানুষের কাছে দুদককে ভীতির বদলে প্রীতির কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে দিন-রাত একাকার করে কাজ করছেন।
দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি অবলম্বনের কথা জানিয়ে এ দুদক কমিশনার বলেছেন, ‘দুদক এখন দুর্নীতিবাজদের কাছে ভীতিকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
সে কারণে দুদক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সব ধরণের হস্তক্ষেপের ঊর্ধ্বে থেকে নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন করছে।’
নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়েছেন, নিজেদের সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে। তদন্তে ও কাজে পদ্ধতিগত ভুল না করতে।
প্রায় সময়েই এ দুদক কমিশনার বলেন, ‘এক সময় দুদককে নিয়ে মানুষ ব্যঙ্গ করত। কিন্তু সময়টা একখন ইউটার্ণ নিয়েছে। এখন ব্যঙ্গ করার সুযোগ নেই। আমরা মানুষের ভীতির কারণ না হয়ে প্রীতির কারণ হতে চাই।’
সূত্র জানায়, দেশের ২৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্য প্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগত অনিয়ম-দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করতে দুর্নীতি দমন কমিশন ২৫ টি প্রতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে। এসব টিমের সুপারশিসমূহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এসব প্রেরণ করেন কমিশনের কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে দুদক। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অন্তত অর্ধশত হাসপাতাল পরিচালক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীকে আসামি করে ১১ টি মামলা করে দুদক।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমান কমিশন প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক বেশকিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কমিশন ২০১৭ সালেই স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করেছিল।
২০১৯ সালের প্রারম্ভে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির ১১টি উৎস এবং তা নিয়ন্ত্রণে ২৫ দফা সুনির্দিষ্ট সুপারিশ সংবলিত কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত একটি প্রতিবেদন দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিবের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।’
‘স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে ইতোপূর্বে দুদকের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন বাস্তবায়ন করা গেলে হয়তো এ খাতের দুর্নীতির লাগাম কিছুটা হলেও টেনে ধরা সম্ভব হতো,’ যোগ করেন দুদক চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। কমিশন অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছে। অনুসন্ধানটি হতে হবে নির্মোহ ও পূর্ণাঙ্গ। মানুষকে সবকিছু জানাতে হবে। দুদক কোনোকিছুই গোপন করে না, করবেও না।
বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও দালিলিক প্রমাণাদির মাধ্যমে যেমন অপরাধীদের আমলে আনতে হবে তেমনি জনগণের কাছেও কমিশনকে জবাবদিহি করতে হবে। জনগণের এই প্রতিষ্ঠানটি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ।’
দেশপ্রেমই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকারকে সুদৃঢ় করবে বলে মনে করেন ড.মোজাম্মেল। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। তাই জিরো টলারেন্স ঘোষণার নীতিকে সমুন্নত রাখতে হবে। এজন্য অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে।’
সূত্র জানায়, সম্প্রতি জেলা পর্যায়ে নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে এ কমিশন। মাস তিনেক আগে ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে কমিশনের নিজস্ব গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতির কুখ্যাতি রযেছে এমন কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা এবং তথ্যগুলো নিয়মিত প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করবে এসব গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এছাড়া সন্ত্রাস, চাদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি, ক্ষমতার অপব্যবহার-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অনৈতকতার মাধ্যমে যে বা যারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করছেন তাদের সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করবে তারা।
দুদক সূত্র আরো জানায়, এসব কর্মকর্তারা গোপনীয় একটি বিশেষ কোডের মাধ্যমে কমিশনে গোয়েন্দা তথ্য প্রেরণ করবেন। কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের গোয়েন্দা শাখা এসব তথ্য নিয়মিত কমিশনে উপস্থাপন করবে। কমিশন এসব তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
দুদক কখনই ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থান দেখে কাজ করে না বলে মন্তব্য করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত। তিনি বলেন, ‘দুদক চলে তার নিজস্ব গতিতে। এখানে প্রভাবের কিছু নেই। কারও উদ্দেশ্য সাধনে দুদককে ব্যবহার করা হয় না। স্বচ্ছতার সঙ্গেই কাজ করে।’
করোনাকালেও বসে নেই দুদক
প্রাণঘাতী করোনা মহামারির সময়েও হাত গুটিয়ে বসে নেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অদেখা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যেই দু’জন দুদক কর্মকর্তা মারা গেছেন।
চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৫ জনের মতোন কর্মকর্তা-কর্মচারী। সবার রোগমুক্তি কামনা করে দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘প্রতিকূল পরিবেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পালন করতে হচ্ছে আইনি দায়িত্ব।’
দুদকের গোয়েন্দা অনুবিভাগের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর স্বাক্ষরে প্রণীত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কমিশনের অনুমোদনক্রমে বিগত তিন মাসে ত্রাণ দুর্নীতি, সরকারি খাদ্যগুদামের খাদ্যসামগ্রী আত্মসাৎ, অবৈধভাবে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২৩টি মামলা দায়ের করেছে কমিশন। প্রতিটি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও নিয়োগ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার নিমিত্ত নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দ্রুততার সাথে অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে