যেই কথা সেই কাজ, স্বাস্থ্য খাতের অপরাধীদের দুর্গে হানা র‌্যাবের

প্রকাশিতঃ 9:20 am | July 08, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সন্ত্রাস-জঙ্গি দমন থেকে শুরু করে মাদক নির্মূল, একের পর এক চমক সৃষ্টিকারী সাফল্য দেখিয়েছে বিশেষায়িত এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব)। ক্যাসিনো অভিযানে বড়বড় রাঘব বোয়ালদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছে।

নিরাপদ খাদ্যের জন্য ভেজাল দ্রব্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। চরম আতঙ্কের জলদস্যু-বনদস্যুর দমনে রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সুন্দরবনকেও করেছে দস্যুমুক্ত। করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য খাতে নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতিতে ভীতিকর এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বিশেষ করে করোনা পরীক্ষা নিয়ে ভয়ানক জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় এমন অনিয়ম-দুর্নীতির রাশ টেনে ধরতে সক্রিয় তৎপরতা শুরু করেছে র‌্যাব।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার ক’দিন আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন মোবাইল কোর্ট পরিচালনার।

একাধিক গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনিয়ম-দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। প্রয়োজনে র‌্যাবের মোবাইল কোর্ট দিয়ে অভিযান চালানো হবে।’

এর ঠিক দু’দিনের মাথায় করোনা চিকিৎসার নামে প্রকাশ্যে প্রতারণা করে আসা রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে সোমবার (০৬ জুলাই) কঠোর অ্যাকশনেও নামে তারা।

রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো.সাহেদ স্বয়ং ক্ষমতাসীনদের নাম ভাঙিয়ে বা ছত্রছায়ায় ফুলে-ফেঁপে উঠায় করোনার নমুনা পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট তৈরি, বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলে রোগীপ্রতি লক্ষাধিক টাকা বিল আদায়ের মতো অপকর্ম করে আসছিল সবার নাকে ডগাতেই।

কিন্তু অভিযোগ আসার পরই হাত গুটিয়ে বসে না থেকে স্বাস্থ্য খাতের অপরাধীদের দুর্গে হানা দিয়েছে। সব মহলেই প্রশংসা কুড়িয়ে আবারও সাধারণ মানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের প্যারেডে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা এ বাহিনীটি।

জানা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে র‌্যাব মানবিক নানা কাজকর্ম চালিয়ে গেলেও নিজেদের অপারেশনসহ অন্যান্য কার্যক্রমে ভাটা পড়েনি।

নিয়মিতই অবৈধ অস্ত্র, মাদক উদ্ধারসহ অপরাধীদের গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছে। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে সম্পৃক্তরাও র‌্যাবের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

এরই মধ্যে র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ প্রধান হিসেবে ড.বেনজীর আহমেদ দায়িত্ব পাওয়ায় নতুন ডিজি পেয়েছে র‌্যাব। দক্ষতার সঙ্গেই র‌্যাবকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুলিশের অতিরিক্ত আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

সততা, পেশাদারিত্ব ও যোগ্যতার সঙ্গেই পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইউনিটের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা এ র‌্যাব ডিজি মাস দেড়েক আগে করোনা মোকাবেলায় নিজেদের কার্যক্রম সম্পর্কে অনলাইনে সংবাদ সম্মেলনে নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রির বিরুদ্ধে র‌্যাবের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরেছিলেন।

তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে, অবৈধ নিম্নমানের মাস্ক, হ্যান্ডস্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি নিয়ন্ত্রণে র‌্যাব মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। এতে করে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই কোটি টাকার বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে।’

র‌্যাব বরাবরই ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকারীদের সমাজের জন্য নীরব ঘাতক হিসেবেই দেখে এসেছে। ফলে নিয়মিত কার্যক্রমের বাইরেও ভেজালের বিরুদ্ধে কোন তদবির না শুনেই আইনের সফল প্রয়োগও করেছে। জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেই ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে।

করোনার মতো ভয়ঙ্কর দুর্যোগে মানুষের প্রয়োজনীয়তাকে কাজে লাগিয়ে টেস্টের নামে ভুয়া রিপোর্টে রমরমা বাণিজ্যে মেতে উঠা প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধেও কঠোর ভূমিকা নিয়েছে র‌্যাব।

একাধিক গণমাধ্যমের সঙ্গে ক’দিন আগে এক আলাপে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজেদের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা জানান।

জঙ্গিবাদ দমন, মাদক নির্মূল ও ক্যাসিনো বাণিজ্যের হোতাদের গ্রেফতারে একের এক সাফল্যমন্ডিত অভিযানে নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনা দেওয়া চৌকস এ কর্মকর্তা জানিয়ে দেন চিকিৎসার অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিষয়ে নিজেদের নজরদারির বিষয়টিও।

হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে র‌্যাবের এ ‘সেকেন্ড ম্যান’ বলেন, ‘করোনাকে পুঁজি করে যারা ভেজাল স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাসামগ্রী তৈরি ও বাজারজাত করা অসাধুদের কঠোরভাবে দমন করা হবে।

যেসব হাসপাতালে রোগীদের হয়রানি করা হচ্ছে তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় আনা হবে। চিকিৎসাসংক্রান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রমের প্রমাণ আমরা যথাসময়ে দেব।’

ঠিকই স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজ অপরাধীদের বিরুদ্ধে নিজেদের কার্যক্রমের প্রমাণ দিয়েছে র‌্যাব। করোনাকালে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া অপরাধীদের ‘যম’ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে।

উচ্চমহলের সঙ্গে সব সময় চলাফেরা করা সরকারি দলের হোমড়া চোমড়া বলে দাপিয়ে বেড়ানো সাহেদদের মতো মতোন ভুয়াদের প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ন থামিয়ে আইনের আওতায় আনতেও নিজেদের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার কথা জানান দিয়েছে র‌্যাব নেতৃত্ব। তাদের যেই কথা সেই কাজ।

করোনা পরীক্ষা না করেই সার্টিফিকেট প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব। মঙ্গলবার (০৭ জুলাই) বিকেলে উত্তরায় রিজেন্টের প্রধান কার্যালয় সিলগালাও করা হয়েছে।

র‌্যাবের অভিযানের পর ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অবশেষে বাধ্য হয়েই নিজেদের মুখ খুলেছে। রিজেন্ট হাসপাতালের ওই দু’টি শাখার কার্যক্রম তারা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে।

রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় র‌্যাব প্রতারণাসহ বিভিন্ন অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো.সাহেদকে প্রধান আসামি করে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেছে। সাহেদকে গ্রেফতারে র‌্যাবের প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে।

সূত্র জানায়, করোনা পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট তৈরির ১৪ টি অভিযোগ এ হাসপাতালের বিরুদ্ধে র‌্যাবের কাছে জমা পড়ে। র‌্যাব এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে। সব অপরাধের প্রমাণই হাতেনাতে পেয়ে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে।

এসব অভিযোগ ওঠার পরপরই ধুরন্ধর ব্যবসায়ী মো.সাহেদ নিজের অপরাধ ঢাকতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন এবং দু’দিন আগে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু করোনাকালে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল আর পার পায়নি।

এসব অপকর্মের জেরে মামলা এবং গ্রেফতার আতঙ্কে গা ঢাকা দিয়েছেন সাহেদ। তবে এবার আর তার শেষ রক্ষা হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।

করোনাকালে সফলতম ও সাড়া জাগানো এমন অভিযানের মধ্যে দিয়ে র‌্যাবও পুনরায় দেশজুড়ে আলোচনা আর প্রশংসার ডিঙ্গি বেয়েই চলেছে।

কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে