অসহায়ের ‘সহায়’ সেনাবাহিনী, সেনাপ্রধানের ঈদ উপহারে কর্মহীনদের ‘স্বস্তি’ (ভিডিও)

প্রকাশিতঃ 11:30 pm | July 29, 2020

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

দূয়ারে কড়া নাড়ছে ‘ত্যাগের উৎসব’ হিসেবে পরিচিত পবিত্র ঈদুল আজহা। এবারের ঈদ এসেছে বিশেষ পরিস্থিতিতে। করোনা যুদ্ধে অবতীর্ণ সেনাবাহিনীর ‘ফ্রন্টলাইন ফাইটার’ হিসেবে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) চিকিৎসকরা।

ঢাকা সিএমএইচে করোনা চিকিৎসার স সম্পৃক্ত এসব জুনিয়র চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল সহকারী, ওয়ার্ড বয়সহ অন্যান্য অসামরিক ব্যক্তিদের সেনা ‘ঈদ উপহার’ হিসেবে গিফট ভাউচার দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

অন্যান্য সিএমএইচ এর বেলায়ও স্থানীয় পদাতিক ডিভিশনের প্রত্যেক জেনারেল অফিসার কমান্ডিংরা (জিওসি) একইভাবে ‘উপহার’ দিয়ে তাদের উৎসাহিত করেছেন।

এ তো গেল চিকিৎসকরদের গল্প। আবার, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষজনের ঘরে নেই চিরায়ত ঈদ আনন্দ। বাজার সদাই করারও জো নেই অভাবী ও দুস্থ মানুষজনের।

এমন পরিস্থিতিতে অসহায় এসব মানুষের সহায় হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাদের হাতেও পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ‘ঈদ উপহার’।

এ উপহারকে তারা দেখছেন দু:সময়ের অবলম্বন হিসেবেই। এতে করে রীতিমতো স্বস্তি ফিরেছে করোনা সঙ্কটে কর্মহীন এসব মানুষ।

তাদেরই একজন আলী হোসেন (৬৫)। বাড়ি ময়মনসিংহ নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ দিনমজুর আলীর কাজ করার মতো শক্তিও নেই।

ঈদ উপহার হিসেবে তাকে দেওয়া হয়েছে ৫ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি চিনি, ১ কেজি লবণ, ১ লিটার তেল, আধা কেজি সুজি ও ২ টি সাবান।

শুধু আলী হোসেনই নন, করোনায় কর্মহীন অসহায় এমন আরও প্রায় ৬ শতাধিক মানুষজনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনীর অধীনস্থ ৪০৩ ব্যাটেল গ্রুপ ও ২১ ইষ্ট বেঙ্গল।

বুধবার (২৯ জুলাই) সকাল ১১ টার দিকে গরিব ও দুস্থ মানুষজনের হাতে সেনাপ্রধানের ঈদ উপহার সামগ্রী তুলে দিয়েছেন আর্টডকের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

উপহার সামগ্রী পাওয়া নগরীর গোহাইলকান্দি এলাকার খোদেজা আক্তার আঞ্চলিক ভাষায় কালের আলোকে বলেন, ‘ঈদের দিন কি খামু ভাইব্বা (ভেবে) পাইতাছিলাম না।

হঠাৎ হুনলাম (শুনলাম) সেনাবাহিনী ত্রাণ দিবো। সকাল সকাল চইল্লা (চলে) আইছি (এসেছি)। অহন (এখন) আর কোন চিন্তা নাই।’

খোদেজা কথা বলছিলেন আর তার চোখে-মুখে তখন খুশির ঝিলিক। নিশ্চিন্ত মনে এবার তাঁর উচ্চারণ দাঁড়ায় এমন- ‘সেনাবাহিনীর মতোন যদি সবাই হতো। আমাদের দুশ্চিন্তা কমতো।’

অনাবিল আনন্দের এমন দৃশ্যকাব্য কেবল ময়মনসিংহের নয়। চোখ মেললেই ভেসে ওঠছে সেনাবাহিনীর প্রতিটি ডিভিশনে এমন একেকটি চিত্রপট।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনায় গড়ে উঠা দেশপ্রেমিক এই বাহিনীটির সদস্যরা দায়িত্বের পরিশীলিতার পাশাপাশি হৃদয়-মনের দায়বদ্ধতা থেকেও মনের আনন্দেই পরিণত করছেন এমন সব রঙিন ক্যানভাস।

পথে পথে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের ফল্গুধারা। পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠানো সময়ের মতোই চলমান করোনা যুদ্ধে সুশৃঙ্খল সেনারা মানবিকতার এক অনবদ্য ঐকতানিক সুর গেঁথে দিচ্ছেন সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন, কুতুবদিয়া থেকে তেতুলিয়া।

জানা যায়, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও বিস্তৃতি রোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের নেতৃত্বে এ যুদ্ধে সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে আবির্ভূত হন।

সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে নিজেদের জীবনবাজি রেখেছেন। জনগণের পাশে থেকে কাজ করছেন নিরন্তর।

দেশের এই ক্রান্তিকালে সেনাবাহিনীকে জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগের সুযোগ দেওয়ায় সেনাবাহিনীর সব সদস্যের পক্ষে ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

নিজেদের রেশনের টাকা থেকে দেশের ৬২ টি জেলায় সেনাবাহিনী অভাবী ও গরিব সাধারণ মানুষকে খাবারের জোগান দিচ্ছে। তাদের এমন মানবিক সহায়তা কার্যক্রম দেশজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে।

একই সঙ্গে শহর-গ্রাম ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেনাবাহিনী বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়সহ হাট-বাজারে সাধারণ মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে উৎসাহিত করছে।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে এসব সুরক্ষা সামগ্রী পর্যাপ্ত পরিমাণে বিতরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জীবাণুনাশক ছিটানোর পাশাপাশি জীবাণুমুক্তকরণ টানেল স্থাপন করা হয়েছে।

আর্টডকের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ‘ঈদ উৎসবে মাননীয় সেনাপ্রধানের নির্দেশে গরিব, অসহায় ও কর্মহীন মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে আমাদের মানবিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়ে খাবার সহায়তা আমাদের বহুমুখী কার্যক্রমের একটি। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় গত ২৫ মার্চ থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা দিতে ৬২ জেলায় আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও অসহায় মানুষের সেবায় ভবিষ্যতেও সাধ্যানুযায়ী আমাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চলমান থাকবে।’

আর্টডক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আর্টডকের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানসমূহ ইতোমধ্যেই ১২ হাজারের অধিক দরিদ্র ও অসহায় পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ, ৭ হাজারের অধিক ফেস মাস্ক, সহস্রাধিক হ্যান্ডস্যানিটাইজারসহ নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

আর্টডকের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমদ মানবিক কার্যক্রমের সার্বক্ষণিক তদারকি ও নির্দেশনা প্রদান করছেন।

একই সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে মেডিক্যাল ক্যাম্প পরিচালনার পাশাপাশি করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য কর্মীদের পাশেও এসে দাঁড়িয়েছে আর্টডক।

এ লক্ষ্যে কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য পিপিই, হেড কভার ও সু কভার প্রদান করা হয়েছে।

আরও জানা গেছে, করোনা সঙ্কটে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তায় প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সবজি কেনা এবং বিনামূল্যে সবজির বীজও বিতরণ করা হচ্ছে দেশের ৬২ টি জেলাতেই।

সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশে গত ঈদুল ফিতরের মতোই আসন্ন ঈদেও দুস্থ মানুষের মধ্যে ‘বিশেষ উপহার’ হিসেবে শুকনো সেমাই, চিনি এবং আনুষঙ্গিক খাবার বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।

গত বৃহ্স্পতিবার (২৩ জুলাই) সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কক্সবাজারে খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ অমিত দৃঢ়তায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যেকোনো সময় নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করে থাকে।’

বলেছেন, ‘জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশ গঠনের কাজে নির্ভরতা, বিশ্বস্ততা এবং সফলতার প্রতীক হয়ে আছে এবং ভবিষ্যতেও এই ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন থাকবে ইনশাল্লাহ।’

অভিন্ন সুরে সবাই বলছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের পর করোনা যুদ্ধেও দেশের সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে ঠাঁই করে নিয়েছেন নিখাদ দেশপ্রেমিক সেনারা।

জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও গরীয়ান, সেনাদের বিরামহীন কর্মযজ্ঞ যেন এ বার্তাই দিচ্ছে। পরতে পরতে উচ্চারিত হচ্ছে-দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুলের অবিনাশী সেই উচ্চারণ ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী।’

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়- ‘জননীর স্তন্যপানের যদি কোনো ঋণ থাকে, তবে তারও চেয়ে বড় ঋণ আমাদের দেশ-জননীর কাছে- যার জলবায়ু ও রসধারায় আমাদের প্রাণ মন দেহ অনুক্ষণ সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে- সে দেশ আমার পিতার জননী, আমার জননীর জননী।’

কালের আলো/আরআর/এমএইচএ