অগ্নিঝরা ইতিহাস-বিষাদ-বেদনার অমর কাব্য বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলমের জবানীতে
প্রকাশিতঃ 9:06 am | September 15, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
সবুজ জমিনের ওপর লাল সবুজের পতাকা! এই পতাকা, একটি মানচিত্রের জন্যই ইতিহাসের মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবনবাজি রেখেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব এ কে এম রফিকুল আলম।
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ‘অমলিন স্মৃতি’; প্রতিনিয়ত ‘আপ্লুত’ বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম
স্বাধীনতার ৪৯ বছরের মাথায় মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা ইতিহাস, বিষাদ ও বেদনার অমর এক মহাকাব্য উচ্চারিত হয়েছে জাতির এ সূর্য সন্তানের জবানীতে। জীবনের গোধূলী বেলায় উল্টেছেন স্মৃতির বর্ণিল পাতা।
বাঙালির জীবনে অন্তনির্হিতি শক্তির উৎস হিসেবে পরিচিত মার্চ মাস আর গৌরবদীপ্ত মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত উপকথা তুলে এনেছেন অবিস্মরণীয় দৃঢ় মানসিকতায়।
স্বাধীনতাহীন যাপিত জীবনে পাকিদের বর্বর-নিষ্ঠুরতা আর পৈশাচিকতার দিনগুলোতে বাস্তবিক ক্যানভাসে আঁকা ছেলেহারা কতো দু:খিনী মায়ের অশ্রুভেজা দু’ চোখ, বীরাঙ্গনার আঁচলে ঢাকা সেই মুখ আর ত্রিশ লাখ শহীদের এক সাগর তাজা রক্তে অঙ্কিত প্রিয় স্বাধীনতার গল্প বলেছেন অদম্য সাহস আর প্রবল আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গেই।
১৯৬৩ সালে বিএসসি পাস করা এ কে এম রফিকুল আলম সেই গোপালগঞ্জের পুণ্য ভূমির বাসিন্দা। সেখানকার সদর উপজেলার কাঠি ইউনিয়নের সুলতানপুর মানিকহার তাঁর গ্রাম। সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া রফিকুল আলমের বাবা ছিলেন চিকিৎসক।
চাচা ছিলেন ব্রিটিশ আমল থেকেই ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। নিজে চাকরি করেছেন বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে। সেখানে চাকরিরত অবস্থাতেই স্বাধীনতাকামী একজন বাঙালি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের আস্বাদ নিতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। সম্মুখ যুদ্ধে হটিয়েছিলেন পাকিদের।
বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিকামী বাঙালিদের জন্য যখন হাজার বছরের অব্যক্ত আকাঙ্খার পঙক্তিমালা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ উচ্চারণ করলেন তখন রক্ত টগবগিয়ে ওঠে সেই সময়ে তরুণ যুবা এ কে এম রফিকুল আলমেরও।
মুক্তি আর স্বাধীনতার দাবিতে অগ্নিগর্ভ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটিতে কীভাবে এসেছে চির আরাধ্য স্বাধীনতা তাঁর সারি সারি চিত্রপট রচনা করে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্মৃতিচারণধর্মী একটি অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম রফিকুল আলম।
বাঙালির চোখজুড়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন
একাত্তরের রণাঙ্গণের লড়াকু সৈনিক এ কে এম রফিকুল আলম নিজের লেখার শুরুতেই সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন বাঙালির স্বাধীনতা ও গৌরবগাঁথার মার্চ মাসকে। সেখান থেকেই সূত্রপাত করেছেন নিজের তুণের সমৃদ্ধ তথ্যভান্ডার।
নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনায় শাণিত করেছে এ বীর সেনানীর একাত্তরের বাস্তবিক এসব ঘটনাপ্রবাহ। পাকিদের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধ সংগ্রামের স্মারক সেই মাসটিকে স্মৃতির গভীর দ্যোতনায় তুলে এনেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে লিখেছেন- ‘১৯৭০’র ঐতিহাসিক নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্তে¡ও ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়ার টালবাহানা, বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গাজীপুরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে বাঙালিদের প্রবল প্রতিবাদ-বিক্ষোভের কথা।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ জাদুকরী ভাষণে চির আরাধ্য স্বাধীনতার অপেক্ষায় অপেক্ষমান বাঙালি জাতিকে দীপ্ত মুক্তিসেনানিতে রূপান্তরিত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও ক্যারিশমার মিশ্রণও তিনি তুলে আনতে ভুল করেননি মোটেও।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম রফিকুল আলম লিখেছেন- ‘১৯৭০ সালের শেষ ভাগে আমি পাকিস্তান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি, রাওয়ালপিন্ডি থেকে বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি, গাজীপুর সেনানিবাসে বদলি হয়ে আসি। কিছু দিন পরেই পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সেবারের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করে। কিন্তু সামরিক জান্তা প্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছিল না। বারবার মিটিংয়ের নামে অন্যায়ভাবে কালক্ষেপণ করছিল। ফলে সমগ্র বাঙালি জাতি বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে সমগ্র দেশব্যাপী গণমিটিং, মিছিল চলতে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্রনেতারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও পরামর্শে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ শুরু করে। তারা জাতীয় পতাকার রূপরেখা তৈরি করে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে প্রহসনমূলক কালক্ষেপণ করতে থাকে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম আনতে থাকে।
ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সকল অফিস, আদালত, ব্যাংক, বিমা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।
সেদিন লাখ লাখ জনতা রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়ে তাঁর ভাষণ শোনেন। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা ঘোষণা করেন। সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় গাজীপুরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে স্থানীয়ভাবে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রতিদিন মিটিং, মিছিল চলতে থাকে। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি এক সেনা অফিসারকে গাজীপুরে হত্যা করার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা গাজীপুরে ঢোকার চেষ্টা করে। এ সময় আন্দোলন চরমে ওঠে এবং আন্দোলনকারীরা রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেয়, যাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা থেকে গাজীপুরে আসতে না পারে।
পাকিস্তানি সেনারা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীদের বাধার মুখোমুখি হয়। পাকিস্তানি সেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে কিছু আন্দোলনকারী আহত ও নিহত হয়।’
নানা ঘটনা পেরিয়ে ২৫ শে মার্চ বাঙালি জীবনে আসে নিকষ কালো রাত। পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে হত্যা করে ঘুমন্ত সাধারণ মানুষকে। এই মাসেই সাধারণ বাঙালি হয়ে উঠে অসাধারণ যোদ্ধায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে গাজীপুরের বীরত্বগাঁথা, উত্তাল মার্চে মৃত্যুপুরী ঢাকা শহর, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির ভেতর প্লেন থেকে পাকিদের বোমাবর্ষণ ও শেলের আঘাতে সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে রক্ষা, দু’সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এক কাপড়ে কারখানা ছেড়ে বেরিয়ে আসা, বিহারী ও হিন্দুস্তানি কর্মকর্তাদের গাত্রদাহ-সবকিছুই স্মৃতির মানসপট থেকে তুলে এনেছেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।
সেইসব কথা তুলে ধরে নিজের স্মৃতিকথায় তিনি আরও উল্লেখ করেন- ‘ইতোমধ্যে ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অতর্কিতে ঢাকায় নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যা করতে থাকে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ লাইন ও পিলখানাকে (ইপিআর) প্রধান টার্গেট করে হাজার হাজার লোককে হত্যা করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় লোকমুখে একদিন পরে আমরা গাজীপুরে খবর পেলাম যে ঢাকা শহরকে পাকিস্তানি সেনারা মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলছে এবং বাঙালি কাউকে সামনে পেলেই তাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে।
২৯ মার্চ বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গাজীপুরে রাস্তার ব্যারিকেড ভেঙে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং সম্মুখভাগে প্লেন থেকে বোমা ফেলতে থাকে। অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির ভেতরেও তারা প্লেন থেকে বোমাবর্ষণ করেছিল। সেনারা যাকে সামনে পাচ্ছিল তাকেই গুলি করে মারছিল। ওই সময় আমি কারখানার এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে যাওয়ার সময় অল্পের জন্য সৌভাগ্যক্রমে শেলের আঘাত থেকে বেঁচে যাই।
দেখলাম, ভয়ে সবাই কারখানার সীমানার বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং কারখানা থেকে বাসায় চলে যাচ্ছে। উলেখ্য, ওইদিন আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাইরে আসার সময় সমরাস্ত্র ভাণ্ডার খুলে দেয় এবং যে যত পারে রাইফেল ও বুলেট বাইরে নিয়ে আসে। আমি তাৎক্ষণিক বাসায় গিয়ে আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘পাকিস্তানি সেনারা অল্প সময়ের মধ্যে কারখানায় ঢুকে পড়বে। শুনলাম তারা বাঙালি যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে। আমাদের এখনই কারখানার সীমানার বাইরে চলে যেতে হবে। পরিস্থিতি শান্ত হলে আমরা আবার ভেতরে চলে আসবো।’
তখন আমার বড় মেয়ের বয়স তিন বছর এবং মেজ ছেলের বয়স এক বছর। এই দুজনকে সঙ্গে নিয়ে এক কাপড়ে কারখানার বাইরে চলে যাই। সঙ্গে নিলাম শুধু একটি বাস্কেট, যাতে বাচ্চাদের জন্য দুধ, কিছু বিস্কুট, ফিডার, সামান্য কাপড়চোপড় ও একটি মাত্র তোয়ালে ছিল। বড় ছেলে আগেই তার দাদার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। এভাবে আমরা কারখানার পশ্চিমের গেট দিয়ে বের হয়ে পশ্চিম দিকে চলতে থাকি। চলার পথে লোক মারফত জানতে পারি পাকিস্তানি সেনারা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে ঢুকে পড়েছে। বাঙালি কর্মচারী যারাই কারখানায় ঢুকছে তাদের পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করছে।
চার যুগ পরেও সেইসব স্মৃতি জীবন্ত তাঁর মনে
ইতিহাসের দিনপঞ্জির গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিহাসই মানুষকে ভাবায়, তাড়িতও করে। ঠিক সেইভাবে এখনও একাত্তরের মার্চ আন্দোলিত করে বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম রফিকুল আলমকে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এলাকার লোক।
নিজের ঘটনাবহুল স্মৃতিচারণে এক কাপড়ে জোলারপাড় নামক গ্রামে থাকা, সেই নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারের প্রতি তাঁর অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকারান্তরে তাঁর বড় মনেরই পরিচয় বহন করেছে যেন! সেখানেও পাকি হায়েনাদের তান্ডবে টিকতে না পেরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের পরিবারে আশ্রয় নেওয়া-কী দু:সহ বেদনাবহ স্মৃতিরই নামান্তর।
অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির গেট ইন্সপেক্টর আব্দুর রশিদের অসহায় দিগভ্রান্তহীন মানবতার জন্য খাবার বিতরণ, পথে পথে পায়ে হেঁটে আবার কখনও বাসে, ছইওয়ালা নৌকায় চেপে ফরিদপুরে পৌঁছানো, নৌকায় মুকছুদপুরের মালদীয়া গ্রামে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির তাঁর এক সহকর্মী আলী আশরাফের বাড়িতে যাওয়া কোন কিছুই বাদ যায়নি স্মৃতিচারণ থেকে।
কত কাঠ-খড় পুড়িয়ে প্রায় এক মাস এখানে-ওখানে থেকে গোপালগঞ্জ সদরের কাঠি ইউনিয়নের সুলতানপুরের মানিখারের নাড়িপোতা ভিটায় পৌঁছানোর অপার আনন্দ, পাকিদের ধর্ষণ, শিশু ও ষাটোর্ধ্ব ছাড়া বাকীদের বাড়ি ছেড়ে বিলে আশ্রয় নেওয়া, স্থানীয় বাদশা মোল্লার বাড়িতে পাকিদের হানা, তিন কিশোরসহ ৭ জনকে ব্রাশফায়ারে হত্যাসহ মর্মান্তিক নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ বিষণ্নতার অতল সাগরে যে কাউকে ডুবিয়ে দিবে নিমিষেই।
একাত্তরে পাকিদের হটানো এ বীর মুক্তিযোদ্ধা সেই সময়ের ঘটনা পরিক্রমা তুলে আনতে গিয়ে লিখেছেন-‘আমরা পশ্চিম দিকে চলতে চলতে জোলারপাড় নামক এক গ্রামে মণ্ডল বাড়িতে আশ্রয় নিই। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ ছিল না। যদিও পাকিস্তানি সব সিনিয়র অফিসাররা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ভালোবাসতেন এবং স্নেহ করতেন; কিন্তু বিহারি ও হিন্দুস্তানি কর্মকর্তা কর্মচারীরা আমাকে হিংসা করতো। তারা আমাকে মিছিলের সম্মুখভাগে দেখতো এবং জানতো যে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এলাকার লোক।
আমি জানতাম কারখানার ভেতরে গেলে বিহারিরা ষড়যন্ত্র করে আমাকে মেরে ফেলবে। তাই ৪-৫ দিন এক কাপড়ে ওই গ্রামে থাকলাম। বাড়ির মালিক ছিলেন একজন নিম্নবিত্ত কৃষক। তারা আমাদের সাদরে গ্রহণ করেছিল। আমার স্ত্রী নিজেই আমাদের খাবার রান্না করতেন এবং আমি বাজার করে দিতাম। সেই সময় রাতে বেশ শীত পড়তো। ওই বাড়ির লোকজন আমাদের মোটা মোটা কাঁথা দিয়েছিল, যার দ্বারা রাতের শীত নিবারণ করতাম। দিনে রোদে বসে থাকতাম। আমরা এখনও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
পরবর্তী সময়ে জানতে পারলাম পাকসেনারা বাইরে এসেও কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুঁজছে এবং যাকে পাচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং গুলি করে হত্যা করছে। কয়েকদিন জোলারপাড় গ্রামে থাকার পর নৌকায় ভাওয়াল মির্জাপুর নদীর ওপারে গিয়ে পুনরায় চলতে থাকি এবং সন্ধ্যাবেলায় সাকেশ্বর নামক এক গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুস সাত্তারের বাড়িতে আশ্রয় নিই।
তারা সাদরে গ্রহণ করে এবং আমাদের পেয়ে খুব খুশি হয়। এই বাড়িতে আমরা আরও ৫-৬ দিন থাকি। বাড়ির লোকজন আমাদের রান্না করতে দিতো না। তারাই রান্না করে আমাদের খাওয়াতো। ইতোমধ্যে আমাদের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির আরও কয়েকজন সহকর্মীর পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়। তারা জানায়, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি। দুই-চার জন যারা কাজে যোগ দিয়েছিল সেনারা তাদের গুলি করে হত্যা করেছে। অতএব, আমরা গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
দিনের বেলায় ঢাকা-আরিচা রোডে পাকিস্তানি সেনারা টহল দেয়। তাই দিনের বেলায় যাওয়া চলবে না, রাতের আঁধারে আরিচার দিকে যেতে হবে। সেই অনুযায়ী আমরা সাকেশ্বর গ্রাম থেকে সন্ধ্যার কিছু আগে যাত্রা শুরু করি এবং সন্ধ্যার পরে ঢাকা-আরিচা রোডে উঠি ও হেঁটে হেঁটে আরিচা অভিমুখে চলতে থাকি। কিছু দূর যাওয়ার পরে একটা টেম্পু পেয়ে যাই। আমরা সবাই টেম্পুতে উঠে অনেক রাতে নয়ারহাট ব্রিজে যাই। এর বেশি ট্যাম্পু চালক যেতে রাজি হয়নি। হেঁটে ব্রিজ পার হয়ে পশ্চিম পাড়ের একটি বাড়িতে আশ্রয় চাইলে তারা আমাদের আশ্রয় এবং রাতের খাবার খেতে দেয়।
আমাদের সঙ্গে মানিকগঞ্জের একটি পরিবারের মা ও মেয়ে ছিল। পাকিস্তানে জন্ম হওয়ায় ও সেখানে বড় হওয়ায় তারা বাংলা বলতে পারতো না। এদের নিয়ে রাতে খুবই ঝামেলা হয়। কিছু যুবক তাদের বিহারি আখ্যা দিয়ে ধরে নিয়ে যেতে চাইলো। অনেক কষ্টে তাদের বুঝিয়ে কোনোরকমে এদের রক্ষা করা হয়। এ বাড়িতে আমরা ২ রাত ও ১ দিন থাকি।
পরের দিন খুব ভোরে পায়ে হেঁটে ও একটি টেম্পুতে করে তরা ব্রিজের কাছে আমাদের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির গেট ইন্সপেক্টর আব্দুর রশীদের বাড়িতে যাই। তিনি প্রতিদিন ব্রিজের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের মতো পথচারীদের খাবার বিতরণ করতেন। তার বাড়িতে ২ দিন থাকার পর পায়ে হেঁটে ও পরে বাসে করে আরিচায় আসি। তারপর একটি ছইওয়ালা বড় নৌকা ভাড়া করে আমরা কয়েকটি পরিবার পদ্মা নদী পার হয়ে রাতে ফরিদপুরে পৌঁছাই। রাতে আমরা একটি বাড়িতে আশ্রয় নিই। পরের দিন আমরা সেখানে অবস্থান করি। আমি বাজার করে আনি।
বাজারে ইলিশ মাছ খুব সস্তা ছিল। দুই টাকায় দেড় কেজি ওজনের ইলিশ কিনে আনি। দ্বিতীয় দিনে কিছু দূর হেঁটে, কিছু দূর রিকশায় ও বাসে করে বাখুন্ডা ব্রিজের কাছে যাই। নৌকায় করে ব্রিজের অপর পাড়ে গিয়ে বাসে দ্বিগনগর ব্রিজ পর্যন্ত যাই। সেখান থেকে নৌকায় মুকছুদপুরের মালদীয়া গ্রামে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির আমার এক সহকর্মী আলী আশরাফের বাড়িতে বহু কষ্টে অনেক রাতে পৌঁছাই। উলেখ্য, জনাব আশরাফের পরিবার আরিচা থেকে আমাদের সঙ্গেই ছিল।
এত লম্বা কষ্টের পথ ভ্রমণের ধকল কাটাতে জনাব আশরাফের বাড়িতে আরও ৪-৫ দিন থেকে যাই। যাত্রাপথে সকল শ্রেণির লোকজন আমাদের সাদরে গ্রহণ এবং প্রতিটি কাজে সহযোগিতা করেন। আমরা এসব লোকজনের প্রতি এখনও গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। এভাবে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি আমাদের নিজ গ্রাম গোপালগঞ্জ সদরের কাঠি ইউনিয়নের সুলতানপুরের মানিখারে পৌঁছে যাই। গ্রামে এসে আমরা জানতে পারি পাকিস্তানি সেনারা রাজাকার ও শান্তি কমিটির সহায়তায় বিভিন্ন এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করে।
তারা পুরুষ ও যুবকদের গুলি চালিয়ে হত্যা এবং তরুণীদের ধর্ষণ করে ও পছন্দ হলে তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। অপারেশনের এলাকায় ঘরবাড়ি, বাজারে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালের ১৪ মে জানতে পারলাম, যেকোনও দিন আমাদের গ্রামে পাকসেনাদের অপারেশন হতে পারে। অবশেষে ১৬ মে আমরা নিশ্চিত হলাম ১৭ মে ভোরে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের গ্রামে অপারেশন চালাবে। আমরা গ্রামের লোকেরা সিদ্ধান্ত নিলাম শিশু ও ষাটোর্ধ্ব লোক ছাড়া কেউই বাড়িতে থাকবে না। সবাই এক-দুই মাইল দূরের বিলে আশ্রয় নেবে।
আমাদের পাশের বাড়ির মো. হাফিজুর রহমান বাদশা ভাই কোর্টে চাকরি করেন। তিনি নিয়মিত অফিস করেন এবং তাকে সরকারি পাস দেওয়া আছে। তাই তিনি নিজের ভাইদের নিয়ে বাড়িতে থেকে যান। অন্যদিকে গ্রামের পূর্বপাড়ায় ১৬ মে রাতে মনজু মোল্লা নামে এক ব্যক্তির স্ত্রী কলেরায় মারা যায়।
সিদ্ধান্ত হয় তার জানাজা ও দাফনের জন্য পঞ্চাশোর্ধ্ব দাড়ি ও টুপিওয়ালা লোকেরা বাড়িতে দাফন কাজ সমাধা করবে। সেনাদের অপারেশন শেষে সবাই বাড়ি ফিরে আসবে। আমরা সবাই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খাবার নিয়ে ভোর রাতে দূরে বিলের ভেতর চলে যাই। খুব ভোরেই পাকসেনারা রাজাকারসহ বাদশা মোলার বাড়িতে পৌঁছায়। তারা সে বাড়িতে অবস্থান করে, বাড়ির লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে।
বাদশা ভাইয়ের অফিসের সরকারি পাসও দেখে। তারা বাদশা ভাইদের দেওয়া নাশতা ও গাছের ডালিম খায়। তারপর বাদশা ভাইসহ চার ভাই ও তাদের ১১ বছর বয়স পর্যন্ত তিন ছেলেকে শুয়ে পড়তে বলে। তারা শুয়ে পড়লে তাদের ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে এবং পাঁচটি বড় বড় টিনের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাদের বাড়িঘর, গাছপালাসহ সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই মর্মান্তিক নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।’
চোখে স্বপ্নের অমর জ্যোতি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে বাঙালি জাতিকে তুলে এনেছিলেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। তাঁর এই ভাষণই বাঙালি জাতির চোখে জ্বালিয়ে দিয়েছিল স্বপ্নের অমর জ্যোতি। মূলত বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। সেই থেকেই ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় ঘটে বাঙালি জাতির জীবনে। অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের।
নয়মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের রক্তগঙ্গায় বিশ্বের মানচিত্রে গৌরবময় অভিষেক হয়েছিল যে বাংলাদেশের, শৃঙ্খলমুক্তির সেই সংগ্রামে সম্মুখ লড়াইয়ে পাকিদের উৎখাত করতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম রফিকুল আলমও।
বাংলাদেশের বুকে স্বাধীনতার রক্তলাল সূর্যোদয়ের ভিত্তি সূচনার অকুতোভয় এ সংগ্রামী বিজয়ের বৈজয়ন্তী উড়াতেই নিজের চেতনার অনুরণন ঘটিয়েছেন। গোপালগঞ্জ সদরের কাঠি ইউনিয়নের সুলতানপুরের সেই গ্রামের ১৪ জন বয়স্ক দাঁড়ি-টুপিওয়ালা মানুষকে পাক সেনাদের ব্রাশফায়ারে হত্যার নিষ্ঠুরতা রুদ্ধবাক করেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলমকে।
অসভ্য, বর্বর ও নিষ্ঠুর পাকিদের হাত থেকে প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষায় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনতে রণাঙ্গণে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রতিবাদী সুরের মুর্ছনা যারপরেনাই তাকে আন্দোলিত করে আজও।
এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন-‘বাদশা ভাইদের বাড়ি গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে হওয়ায় সেনারা সেখান থেকে গ্রামের পূর্বদিকে যায়। যাওয়ার পথে প্রত্যেক বাড়িতে আগুন লাগায় এবং বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ লোকদের মারধর করে। পাকসেনারা যখন পূর্বপাড়ায় পৌঁছায় তখন রাতে কলেরায় মারা যাওয়া মৃতদেহ জানাজা শেষে কবরস্থ করার জন্য পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামের ১৪ জন বয়স্ক দাড়ি-টুপিওয়ালা লোক খাটিয়ায় করে মরদেহ কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনারা ব্রাশফায়ার করে তাদের পথের মধ্যেই মেরে ফেলে। সে এক হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক দৃশ্য। চোখে না দেখলে অনুভব করা যায় না। আমরা বহু দূরে বিলের মধ্যে থাকায় বেঁচে যাই।
তারা বিলের দিকেও মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করেছিল। কিন্তু আমরা তাদের রেঞ্জের বাইরে পুকুর পাড়ের আড়ালে ছিলাম, তাই কোনও ক্ষতি হয়নি। বেলা ৩টার দিকে জানতে পারি যে অপারেশন শেষে পাকসেনারা গ্রাম ত্যাগ করেছে। তখন আমরা গ্রামের দিকে ফিরে আসি এবং পাকসেনাদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করি ও শুনি।
এসব দেখে আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই, এই অসভ্য, বর্বর, নিষ্ঠুর পাকিস্তানিদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে বাঁচাতে হবে। যোগ দেই মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে।’
কালের আলো/এসআর/এমএইচ