আইজিপি’র অমূল্য উপহারে সেদিন আনন্দে কেঁদেছিলেন প্রধানমন্ত্রী!

প্রকাশিতঃ 8:49 am | September 09, 2018

অ্যাক্টিং এডিটর, কালের আলো :
পাকিস্তান আমলে কারাগারের বন্দিশালায় লেখালেখির জন্য বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নিয়মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খাতা কিনে দিয়ে আসতেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তথ্য পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর লেখা দু’খানা খাতা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেছিল তৎকালীন পাকি সরকার।

আরও পড়ুন: গোপন নথিতে বঙ্গবন্ধু : ইতিহাসের পাতায় আইজিপি

বাজেয়াপ্ত করা সেই খাতাসমূহ উদ্ধারে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীকে ওই সময়েই দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সফল হয়েছিলেন। কোন একদিন প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির জন্য অমূল্য এক সম্পদ। সেই উপহার পেয়ে সেদিন আনন্দে কেঁদেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

সেইসব স্মৃতি জাতির সামনে নিজেই উপস্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার (০৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে গণভবনে ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচনকালে টুকরো টুকরো স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, ‘আমার মা খাতা কিনে কিনে দিয়ে আসতেন এবং খাতা উদ্ধার করতেন। এসবির রিপোর্টেই পেয়েছিলাম সেখানে দু’খানা খাতা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।

আমি এসবি’র ডিজি জাবেদ পাটোয়ারীকে বললাম, আমার বাবা’র এরকম দু’টি খাতা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, এটা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা?

আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি তিনি (জাবেদ পাটোয়ারী) একদিন আমাকে একটি কাগজে মুড়ানো সুন্দর করে র‌্যাপিং করে একটি বই নিয়ে এসে বললেন, আপনার জন্য একটি উপহার এনেছি। আমি প্রথমত বুঝতে পারিনি। মনে করেছি বইটই হবে। আমি খুলে দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। সেই খাতাখানা তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন। সেই খাতাখানা কারাগারের রোজনামচার প্রথম প্যারায় উল্লেখ করে দিয়েছি।’

পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথি নিয়ে ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে প্রকাশিত বইটির গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংগ্রহে মূল সহায়তকারী। ঐতিহাসিক এই কার্যক্রম সম্পাদনে তাঁর ভূমিকা অনবদ্য এবং প্রশংসনীয়। এক কথায়, বাংলাদেশের ইতিহাস গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক সম্পদ উদ্ধার করে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন এই পুলিশ প্রধান।

আর এসব কারণেই কীনা বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন পুলিশের এই মহাপরিদর্শককে (আইজিপি)। প্রায় আধা ঘন্টার বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী তিনবার ধন্যবাদ জানান বর্তমান পুলিশ প্রধানকে। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়েই এই বইটি প্রকাশের প্রস্তুতি শুরু করেন বঙ্গকন্যা।

সেই তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘২১ বছর পর আমরা সরকারে আসি। সরকারে আসার পর একটি তথ্য পেলাম। এসবিতে নিয়োগ দিয়েছিলাম শামসুদ্দিন সাহেবকে। তিনি আমাকে বললেন, এরকম বেশ কিছু ফাইল ও তথ্য আছে। এর মধ্য থেকে কিছু ফাইল চেয়েছিলেন কিবরিয়া সাহেব (সাবেক অর্থমন্ত্রী) আর মোনায়েম সাহেব। তাদের একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। আমি সরকার প্রধান, আমার পারমিশন ছাড়া তারা ফাইল পেতে পারে না।’

‘আমি সমস্ত ফাইলগুলো নিয়ে আসি তখন। সেগুলো আমি ফটোকপি করি, তিনটা সেট তৈরি করি। একটা সেট আমি আলাদা ট্রাঙ্কে ভরে রেখে দেই একটা সিক্রেট জায়গায়। আরেকটা সেট আমার কাছেই রাখি আরেকটা ফাইল আমি আমেরিকায় ড. এনায়েত রহিম সাহেবের কাছে নিয়ে যাই। তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর ওপর গবেষণা শুরু করেন, বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা করা হয়।’

‘আমাদের কাছে যে কপিগুলো ছিল, আমি আর বেবী মওদুদ, আমার বান্ধবী। আমরা বসে বসে সেগুলো নিয়ে কাজ করতে শুরু করি, আমরা অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করি।’

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার সরকারে আসার পরই পুলিশের বর্তমান আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীকে এসবি’র দায়িত্ব দেয়া হয়। তাকে আমি তথ্য দিয়েছিলাম, এখানে মূল্যবান জিনিস রয়েছে। আমরা এগুলো প্রকাশ করতে চাই। আমি ধন্যবাদ জানাই, জাবেদ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে ২২ জনের টিম গড়ে ওঠেছিল। কত কষ্ট করে তাঁরা এই লেখা উদ্ধার ও প্রস্তুত করেছেন। এগুলো অনেক কঠিন কাজ।’

এই সময় পুলিশ প্রধান ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনছিলেন। আপ্লুত প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘আমি ধন্যবাদ জানাই, জাবেদ পাটোয়ারীকে। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সে তখন এসবি’র জিজি ছিলো। তার সঙ্গে ছিলো ২২ জনের টিম। বক্তব্য শেষে আমি তাদের সঙ্গে ছবি তুলবো। তাদেরকে আমি ওখান থেকে নড়তে দেইনি।

বলেছি, এখানেই বসে থাকতে হবে, এই কাজই করতে হবে। কাজ করতে করতে তাদের ভেতরে এমন এক অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, তারা নিজেরাও কাজের সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল।

এতো আন্তরিকতার সঙ্গে তারা কাজ করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁরা পরামর্শ নিতো। বইয়ের মলাট, মলাটের রং সবকিছু। আমি যা কিছু পেতাম রেহানাকে দেখাতাম। ও না থাকলে তাকে ফটোকপি পাঠাতাম। তার পরামর্শও আমি নিতাম। ববি কিছুদিন তাদের সঙ্গে বসেছিল।’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমানও পুলিশ প্রধান ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী’র প্রতি দুই দফায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আইজিপি ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর কল্যাণে আমরা এই ডকুমেন্টগুলো সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছি।’

প্রসঙ্গত, ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইটির প্রথম খন্ডে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ছায়ার মতো অনুসরণ, বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদন, বিভিন্ন মামলার বিবরণসহ বিভিন্ন দিক ওঠে এসেছে।

ওই দুই বছরে ববঙ্গবন্ধুকে নি:সঙ্গ কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল পাকিস্তানে জননিরাপত্তা আইনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামের পূর্বে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা ‘নিরাপত্তা বন্দি’ শব্দ ব্যবহার করে। কারাগারে বন্দি থাকাকালে দীর্ঘ দুই মাস কখনো কখনো পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে সাক্ষাত করতে দেয়া হতো না।

কালের আলো/এমএইচ/এএ