গোপন নথিতে বঙ্গবন্ধু : ইতিহাসের পাতায় আইজিপি
প্রকাশিতঃ 11:58 am | September 10, 2018
অ্যাক্টিং এডিটর, কালের আলো :
প্রকাশ্যে এসেছে গোয়েন্দা নথির বঙ্গবন্ধু। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথি নিয়ে ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ ১৪ খণ্ডের বইয়ের প্রথম খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে।
আরও পড়ুন: আইজিপি’র অমূল্য উপহারে সেদিন আনন্দে কেঁদেছিলেন প্রধানমন্ত্রী!
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিপুল বুদ্ধিবৃত্তিক রত্ন খোঁজে বের করে অসাধ্য সাধন করে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনীর প্রধান ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার)।
ঐতিহাসিক এই কাজটি সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমান কিংবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর মো: নজরুল ইসলাম একবাক্যে সবাই পঞ্চমুখ ছিলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী’র প্রশংসায়।
টানা ৮ বছর দেশ ও জাতির জন্য অমূল এই সম্পদ বই আকারে প্রকাশের জন্য দিন-রাত একাকার করে খেটেছেন বর্তমান পুলিশ প্রধান। বঙ্গকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রথম জাতির পিতার বিরুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সেসব গোপন নথি সংগ্রহের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে তুলে দেন তিনি তখন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক।
বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দলিলাদি বিশেষভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরতে গিয়ে ঠিক ৮ বছর আগের দিনগুলোতে ফিরে যান ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।
গত শুক্রবার (০৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে গণভবনে বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে ২০০৯ সালে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দায়িত্ব দেন। আমি সেখানে যোগদানের কিছুদিন পর খোঁজ পাই স্পেশাল ব্রাঞ্চে একটি রেকর্ড রুম আছে। আর যেখানে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে যত ধরণের রেকর্ড রয়েছে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে।’
সেই রেকর্ড রুমটি পরিদর্শনের জন্য নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করলে এসবি’র তৎকালীন এই প্রধানকে নানা কায়দায় নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন কর্মকর্তারা। তাঁরা বলতে থাকেন, ‘স্যার সেখানে প্রচন্ড ধূলাবালি। সেখানে ঢুকা যাবে না, সেই রুম সাধারণত খোলা হয় না। সেখানে ধূলার আস্তরণ পড়ে আছে, রেকর্ডগুলো এমনভাবে আছে যেখানে হাত দিলে অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন স্যার। জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে।’
আরো পড়ুন: আইজিপি’র অমূল্য উপহারে সেদিন আনন্দে কেঁদেছিলেন প্রধানমন্ত্রী!
কিন্তু সিদ্ধান্তে অনড় জাবেদ পাটোয়ারী তাদের বলেন, ‘যেই রকমই থাকুক না কেন, আমি রেকর্ডগুলো দেখতে চাই। এরপর আমরা মাস্ক পড়ে ও হাতে গ্লাভস নিয়ে সেখানে ঢুকলাম। পুরো রুমের মধ্যে অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে। রেকর্ডগুলো পুরো রুম জুড়ে এমনভাবে রাখা হয়েছে এখান থেকে রেকর্ড বের করার সাধ্য কারো নেই।
কয়েক হাজার রেকর্ড ফাইলস, কয়েক লক্ষ কপি হবে। আমি এক পর্যায়ে রেকর্ড রুমের একদিকে বস্তায় বাঁধা অনেকগুলো রেকর্ড দেখতে পাই। সেই রেকর্ডগুলো যখন খোলা হয় দেখতে পাই বস্তায় বাঁধা রেকর্ডগুলো বঙ্গবন্ধুর রেকর্ড ফাইলস’ বলতে থাকেন বর্তমান এই পুলিশ প্রধান।
এই বই কীভাবে প্রকাশনার পর্যায়ে এলো তাঁর ইতিহাস তুলে ধরে ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘ওই রেকর্ডরুমের প্রতিটি ফাইলই ৪৭ সালের পর থেকে খোলা। আমি আমার অফিসারদের নির্দেশ দেই প্রতিটি ফাইল সুবিন্যস্ত করে কমপক্ষে ইয়ার ওয়েজ যেন সাজানো যায়। যাতে একটি ফাইল প্রয়োজন হলে আমরা খুঁজে দেখতে পাই। এরপর বঙ্গবন্ধুর ফাইল নিয়ে কাজ করা শুরু করার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন।
তিনি বললেন, ‘তোমাদের ওখানে বঙ্গবন্ধুর ওপরে রেকর্ড আছে সেগুলো সুবিন্যস্ত করে রেকর্ডগুলো তৈরি করতে পারো কিনা, আমরা চেষ্টা করবো কখনো প্রকাশ করার মতো অবস্থায় নিয়ে আসা যায় কিনা।’
এই অমূল্য রেকর্ডগুলো উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা ও সংগ্রামের কথা জানিয়ে এই পুলিশ প্রধান বলেন, ‘আমরা প্রথম শুরু করলাম কিভাবে একে রিপ্রডিউসড করা যায়। ফাইল ও নথিগুলো এমন অবস্থায় ছিলো, নথিগুলো ধরলে বিস্কুটের গুড়োর মতো ঝরঝর করে পড়ে যায়।
কোন পেইজের অর্ধেক নাই, পোকায় কাটা। অবস্থা এমন এর থেকে পাঠ উদ্ধার করা ডিফিকাল্ট। আসলে স্পেশাল ব্রাঞ্চ যে রেকর্ডগুলো রেখেছিলো সেই সময়, তখন স্পেশাল ব্রাঞ্জের দেশব্যাপী যারা এজেন্ট ছিলেন তারা সব লং হ্যান্ড নোট নিতো। এই লং হ্যান্ড নোটগুলো এমন কারসিভে লেখা এখান থেকে পাঠ উদ্ধার করা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো। যেহেতু একেকজন এজেন্ট একেক সময় ডিউটি পালন করেছেন, একেকজনের লেখার স্টাইল একেক রকম। প্রত্যেকের লেখার স্টাইল থেকে আবার পাঠ উদ্ধার আরো দুরূহ ব্যাপার।’
ওই সময়কার এসবি’র চীফ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আরো বলেন, ‘আমরা প্রথমে স্ক্যান করার প্রচেষ্টা নেই। আমরা ন্যাশনাল আর্কাইভের এক্সপার্টদের নিয়ে আসি, কীভাবে আমরা রেকর্ডগুলো সংরক্ষণ ও রিপ্রডিউসড করতে পারি। তাদের কাছ থেকে পরামর্শ মোতাবেক সারাক্ষণ স্ক্যান করতে পারবে এমন ১০ টি স্ক্যানিং মেশিন সংগ্রহ করি।
এবং পরবর্তীতে স্ক্যানে ওঠানোর জন্য যেহেতু প্রতিটি পৃষ্ঠাকে আলাদা করা হচ্ছে। সেজন্য আমরা ফটো মেশিন ক্রয় করে প্রথমে একটি সাদা কাগজের ওপরে একটি পৃষ্ঠা রেখে ওটাকে ফটো মেশিনে আলাদা নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ, আমরা চাচ্ছিলাম না মূল ডকুমেন্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হোক।’
অসাধ্য সাধনের এই গল্প বলতে গিয়ে সৎ, মেধাবী ও পেশাদার এই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘মুল ডকুমেন্ট থেকে ফটো কপি করে ডকুমেন্টগুলো আলাদা করে রাখি। স্ক্যানিং করে দেখলাম এই থেকে আমাদের অফিসাররা প্রায়শই কোন শব্দ অর্ধেক বুঝতে পারছে, অর্ধেক বুঝতে পারছে না। হয়তো কোন পেইজের কয়েকটি লাইন পড়তে পারছে, মাঝখানে অর্ধেক শব্দ বুঝতে পারছে না। কোন কোন জায়গায় পোকায় কেটে ফেলেছে। বৃষ্টির পানি ধুয়ে গেছে।’
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ২২ কর্মকর্তার অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা তুলে ধরে ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘আমাদের ২২ জনের একটি টিম নিরলসভাবে কাজ করে। তাদের কোন ছুটি ছিল না। শুক্রবার-শনিবার ছিলো না। একেকজন এমনও হয়ে গেছে রাত ২ টা, ৩ টা, ৪ টা পর্যন্ত অফিস করে সেখানেই নামাজ পড়ে বেরিয়ে গেছে। এমনও হয়েছে একটি পেইজ পাঠ উদ্ধার করতে কয়েক দিন লেগেছে।’
একটি শব্দ বের করার জন্য চিকিৎসকদের মতো মেডিকেল বোর্ড গঠনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কখনো কখনো একটি শব্দ বের করার জন্য ডাক্তাররা যেমন বোর্ড মিটিং করে রোগ নির্ণয়ের জন্য তেমনি আমরা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বোর্ড করিয়ে দিয়েছি। একেকটি শব্দ ও অক্ষর দিয়ে লাইন বা শব্দগুলো মেলানো হয়েছে। আমরা সিনেমার পর্দার মতো বড় পর্দা কিনে দিয়েছি যাতে করে পর্দায় বড় করে একেকটি অক্ষর দেখা যায়, জিনিসগুলো বুঝা যায় এবং তারা লিখতে পারে। এটি ছিল অসাধ্য সাধনের মতো বিষয়। দিনের পর দিন কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকা।’
বঙ্গবন্ধু’র জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা ও বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আইজিপি।
কালের আলো/এমএইচ/এএ