ব্যবসা পরিচালনা সূচকে উন্নতি করতে বিচার ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন

প্রকাশিতঃ 7:38 pm | April 03, 2021

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলোঃ

পৃথিবীর অনেক দেশ বাণিজ্য বিষয়ক আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাস করতে সংশ্লিষ্ট আইনের যথাযথ প্রয়োগ, কোর্ট কার্যক্রমের অটোমেশন, ইলেকট্রনিক পেমেন্ট সিস্টেমের প্রবর্তন, বিশেষায়িত বাণিজ্যিক কোর্ট চালুকরণ এবং এডিআর কার্যক্রমের সম্প্রসারণের ওপর অধিক হারে জোরারোপ করছে।

কিন্তু বাংলাদেশে বাণিজ্য বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিতে সাধারণ প্রায় ৪ বছর সময় লেগে যায়। তাই ব্যবসা পরিচালনা সূচকে উন্নতি করতে বিচার ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

শনিবার(০৩ এপ্রিল) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা : ব্যবসা পরিচালন সূচকে অন্যতম অনুষঙ্গ’ শীর্ষক ওয়েবিনার এমন অভিমত তুলে ধরেন তারা।

ওয়েবিনারে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ইনভেস্টমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক জগন্নাথ চন্দ্র ঘোষ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর পরিচালক জীবন কৃষ্ণ সাহা রয়, জেট্রো বাংলাদেশের প্রতিনিধি কাজিমুরি ইয়ামাডা, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী এবং ওরিক্স বায়ো-টেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড বাও ওয়েবিনারে নির্ধারিত আলোচক হিসেবে যোগদান করেন।

তরা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে বিদেশি কোম্পানিগুলোর মুনাফা নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার অনুমোদন, বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টরিংয়ের কার্যক্রম চালুকরণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

আলোচকরা ভ্যাট ব্যবস্থাপনা, বন্দরগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কাস্টমস ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, বন্ড প্রবর্তন প্রভৃতি বিষয়ের উপর জোরারোপ করেন। পাশাপাশি বাণিজ্য বিষয়ক আইনসমূহের প্রয়োজনিয় সংস্কার, স্থলবন্দরগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং ব্যাংক পরিষেবা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান বলেন, দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে সরকার বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে এবং আগামীতে তা অব্যাহত থাকবে। বিডা’র ওএসএস সেবা পুরোদমে চালু হলে ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা আরো সহজতর হবে।

তিনি বলেন, আমাদের জিডিপিতে করের অবদান খুবই কম এবং যত বেশি করের আওতা বাড়ানো যাবে ততই করের হার কমানো সম্ভব হবে এবং এটি আমাদের ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। গত অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রায় ৫৫ হাজার নতুন করদাতাকে করের আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছে।

তিনি জানান, সম্প্রতি দেশের সকল বন্দরসমূহের সক্ষমতা বেড়েছে, তবে এক্ষেত্রে আরো উন্নয়নের জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। সরকার গৃহীত বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প যেমন: বে টার্মিনাল, মাতারবারি গভীর সমুদ্র বন্দর, কক্সবাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম এয়ারপোর্ট, চট্ট্রগ্রাম-কক্সবাজার রেল যোগাযোগসহ পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসমূহের কাজ সম্পন্ন হলে আমাদের অর্থনীতিকে যুগান্তকারী পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে।

তিনি বলেন, সামনের দিনগুলোতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা মোকাবিলার জন্য সরকার মানব সম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে এবং গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে আরো বেশি হারে গুরুত্বারোপসহ বিশেষ বরাদ্দ বৃদ্ধির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

এ সময় মামলা পরিচালনার দীর্ঘসূত্রিতা নিরসনকল্পে ‘মামলার সময় ব্যবস্থাপনা’ উন্নয়নের প্রতি জোরারোপ করেন প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সরকার অনেক সময় বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সত্ত্বেও ব্যাংক, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট মহলের নিকট তা যথাসময়ে না পৌছানোর জন্য জরিপের সময় কম পয়েন্ট পেতে হয়। এতে সংস্কার করেও তেমন লাভ হয় না। এজন্য যে কোনো সংস্কারের সংবাদ দ্রুত সময়ে ব্যবসায়ী মহলসহ সকল স্তরে যেন সবাই প্রচার করে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার জানান, ব্যবসা পরিচালনার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নয়নে সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তাবায়ন করেছে। আরবিট্রেশন, ব্যবসায়িক চুক্তি বাস্তবায়ন এবং দেউলিয়াত্ব প্রভৃতি বিষয়ে দেশের বেসরকারিখাতকে সরকারের পক্ষ হতে প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কার সহায়তা প্রদান করা হবে।

তিনি বলেন, বাণিজ্য বিরোধ বিষয়ক মামলা পরিচালনায় ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার আওতায় ই-ফাইলিং, প্রমাণাদি সংরক্ষণে ডিডিটাল ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হবে, ফলে এ ধরনের বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।

তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান দেউলিয়াত্ব আইন-১৯৯৭ সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি সহজতর করার জন্য সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রামে ‘কমার্শিয়াল কোর্ট’ ও কমার্শিয়াল এপিলেট কোর্ট স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

ওয়েবিনারের স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, বাংলাদেশে বাণিজ্য বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিতে সাধারণ প্রায় ৪ বছর সময় লেগে যায়, তবে পৃথিবীর অনেক দেশ বাণিজ্য বিষয়ক আইনি প্রক্রিয়ার এ ধরনের দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাসকরণে সংশ্লিষ্ট আইনের যথাযথ প্রয়োগ, কোর্ট কার্যক্রমের অটোমেশন, ইলেকট্রনিক পেমেন্ট সিস্টেমের প্রবর্তন, বিশেষায়িত বাণিজ্যিক কোর্ট চালুকরণ এবং এডিআর কার্যক্রমের সম্প্রসারণের উপর অধিক হারে জোরারোপ করছে।

তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সূচক’-এ বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৫ এবং প্রতিবেদনে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর সমক্ষতা বাড়ানোর উপর জোরারোপ করা হয়।

প্রতিযোগিতার সক্ষমতার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নয়নে বেসরকারিখাতের অংশগ্রহণে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি এবং বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে আরো অধিক হারে এডিআর ব্যবহারকে উৎসাহিত করার আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, প্রতিযোগী সক্ষমতায় উন্নতি প্রবৃদ্ধি, রফতানি বহুমুখীকরণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে।

ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাত্তার অ্যান্ড কোং-এর প্রধান মো. সামির সাত্তার। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোর বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির সময়সীমা কমানোর লক্ষ্যে ‘সিভিল প্রসিডিউর কোড (সিপিসি)’-এর সংস্কার একান্ত জরুরি, সেই সাথে মামলার ক্ষেত্রে ই-ফাইলিং প্রক্রিয়া ও কোর্ট ফি প্রদানের ক্ষেত্রে ই-পেমেন্ট ব্যবস্থার প্রবর্তন, ইলেকট্রনিক কেইস ম্যানজেমেন্ট প্রভৃতি চালু করা যেতে পারে।

তিনি আরো বলেন, ‘ব্যবসা পরিচালন সূচক’-এ দেউলিয়ার বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সে লক্ষ্যে একটি রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক গঠন করা যেতে পারে।

তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে বাণিজ্য বিরোধ ইস্যুগুলোর সমাধানের গতি আনায়নের আরবিট্রেশন, মিডিয়েশন এবং লিটিগেশন প্রভৃতি বিষয়ের উপর আরো অধিক হারে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।

কালের আলো/বিএ/এমএম