ন্যাশনাল ব্যাংকে অন্তকোন্দল, ঝুঁকিতে বিনিয়োগকারীরা

প্রকাশিতঃ 11:26 am | April 11, 2021

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি ন্যাশনাল ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিতে রয়েছেন। ব্যাংকটির নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে নানামুখী সংকটে পড়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। অনুমোদন ছাড়া বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের প্রস্তুতি নিয়ে কিছু ঋণ বিতরণও করেছে।

ফলে ঋণ বিতরণে অনিয়ম, নেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরিচালনা পর্ষদে শুরু হয়েছে বিবাদ সব মিলিয়ে অস্থির অবস্থায় ন্যাশনাল ব্যাংক। আর অভ্যন্তরীন অন্তকোন্দলের ফলে এখন শঙ্কায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এখন থেকে ঋণ বিতরণে তাদের অনুমোদন নিতে হবে। দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেই ন্যাশনাল ব্যাংকে। ব্যাংকটির অতিরিক্ত এমডি এ এস এম বুলবুল এমডির চলতি দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাকে সরিয়ে দিতে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার তার মেয়াদ বাড়ান, যা কার্যকর হয় ১ এপ্রিল থেকে।

কিন্তু বিষয়টি বিধি পরিপন্থি হওয়ায় তাকে চলতি দায়িত্ব থেকে বিরত রাখতে আরেকবার (৬ এপ্রিল) নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে এখন এমডিশূন্য অবস্থায় চলছে ব্যাংকটির কার্যক্রম।

জানা গেছে, সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর ব্যাংকের পরিচালনা নিয়ে পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ঋণ বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করা অতিরিক্ত এমডির কাজ করা নিয়ে এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাদের দফায় দফায় নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর কোনো পর্ষদ সভা হয়নি। কিন্তু ঋণ বিতরণ অব্যাহত রাখা হয়েছে, যেখানে বেশকিছু অনিয়মের ইঙ্গিত পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। (সাধারণত বড় ঋণ বোর্ডসভায় অনুমোদিত হতে হয়।)

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর ব্যাংকটি নিজেদের একক নিয়ন্ত্রণে নিতে চাচ্ছেন পরিচালক রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার। তারা দুজনই জয়নুল হক সিকদারের ছেলে। তবে মেয়ে সাংসদ পারভীন হক সিকদারসহ অন্য পরিচালকরা চাচ্ছেন নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে। অনিয়ম করে ঋণ বিতরণসহ নানা কারণে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ব্যাংকটির পরিচালকদের মধ্যে দুটি পক্ষ হওয়ায় পর্ষদে বিবাদ শুরু হয়েছে। অতিরিক্ত এমডি এ এস এম বুলবুলের নিয়োগ নিয়েও দ্বিমত রয়েছে অনেক পরিচালকের।

অন্যদিকে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে ঠিক তখন থেকেই। ব্যাংক ছাড়াও বিমা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, নির্মাণ, হোটেল, পর্যটন, এভিয়েশনসহ বিভিন্ন খাতে গ্রুপটির ব্যবসা রয়েছে। এ ছাড়া বিনিয়োগ আছে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডসহ আরও অনেক দেশে। অন্য দেশে করা বিনিয়োগের উৎস নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

সিকদার গ্রুপের হাতে যাওয়ার পরে পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও বেনামি ঋণের কারণে ২০১৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। জরুরি ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েও ন্যাশনাল ব্যাংকের খারাপ হওয়া রোখা যায়নি। এখন দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোর একটি ন্যাশনাল ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের অনেকগুলোই সিকদার পরিবার ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হচ্ছে। আবার বেনামি ঋণ সৃষ্টি করেও পরিবারটি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে।

এছাড়া আইনে এক পরিবারের চারজন পরিচালক থাকার কথা বলা হলেও ন্যাশনাল ব্যাংকে আছেন সিকদার পরিবারের পাঁচজন। আইন, নীতিমালা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি কোনো কিছুই যেন ন্যাশনাল ব্যাংক ও পরিবারটির জন্য প্রযোজ্য নয়।

বর্তমানে ব্যাংকটির ১১ সদস্যের পর্ষদে আছেন চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার, পরিচালক তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার, মেয়ে পারভীন হক সিকদার, ছেলে রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার। এ ছাড়া সিকদার ইনস্যুরেন্সের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা বদিউল আলম। অন্য পরিচালকেরা নামে থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। অনেকে পর্ষদ সভাতেও নিয়মিত আসছেন না।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চলমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংকের বিষয়ে গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের চলতি দায়িত্বে থাকা এমডিকে দায়িত্ব থেকে বিরত রাখতে বলা হয়েছে। তাদের ঋণ বিতরণ ও মঞ্জুরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ঋণের কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। এখন তারা যদি এসব নির্দেশনা না মানে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ এস এম বুলবুল জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাকে এমডির চলতি দায়িত্ব থেকে বিরত থাকতে বলেছে। নির্দেশনা পাওয়ার পরই আমি দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। এখন কে চালাচ্ছে বা কাকে পর্ষদ নিয়োগ দেবে তা আমি বলতে পারব না। কিন্তু ৭ এপ্রিল রাতেও ন্যাশলান ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এমডির চলতি দায়িত্বে এ এস এম বুলবুলের নাম দেখা গেছে।

ব্যাংকের ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের তথ্যাদি চাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে এএমডি বুলবুল বলেন, এটি নতুন কিছু নয়। সময় সময় বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের নির্দেশনা দিয়ে থাকে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের তথ্য চাওয়া হয়েছে, তা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। পর্ষদের মতবিরোধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বুলবুল বলেন, আমি এর কিছু জানি না। যাদের কাছে শুনেছেন তাদের জিজ্ঞাসা করলে ভালো বলতে পারবে।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা, চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ৪২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে আমানত ছিল ৪৩ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। মার্চে বেড়ে হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা।

১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ার দীর্ঘ দিন ধরে ফেসভ্যালুর নিচে রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটির ১০ টাকা মূল্যে প্রতিশেয়ার ৭ টাকা ১০ পয়সা থেকে ৭ টাকা ৩০ পয়সায় কেনাবেচা হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছিল ব্যাংকটি।

কালের আলো/কেএসবি/এমএম