‘শক্তিসিন্ধু মাঝে রহি হায়’

প্রকাশিতঃ 10:47 am | May 25, 2021

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান :

রাঢ় বাংলায় গ্রীষ্ফ্মের খরতাপে জন্ম নেওয়া (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬) এবং বাড়ির পাশের অজয় নদীর মতো দু’কূল ভাসানো প্রাণশক্তির অধিকারী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শেষ জীবন এমন কাটবে কে কল্পনা করেছিল? ক্লান্তত আয়ত দুটো চোখ। নির্বাক, বধির এবং অচঞ্চল। দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় প্রায় তিন দশক ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন কবি। অতঃপর ১৯৭৬ সালে ২৭ আগস্ট (বাংলা ১২ ভাদ্র, ১৩৮৩) পিজি হাসপাতালে কবির বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে। তিনি জাতির বরেণ্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমি যখন তাকে প্রথম দেখি, তখন কে বলবে তিনিই নিখিল বঙ্গের বিদ্রোহী কবি, যিনি একদা কাব্য, কবিতায় ও সংগীতে অমিত প্রাণবন্যা, তেজ ও তারুণ্য বুকে ধারণ করে নিখিলবঙ্গ তথা পরাধীন ভারতের জরা দেহে এনেছিলেন মহাসাগরের কল্লোল।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে (১৮২৪-১৮৭৫) বাংলা কাব্যে ওজস্বিনী ছন্দের উদ্গাতা মাইকেল মধুসূধন দত্ত। ইংরেজি তথা ইউরোপীয় সাহিত্যে অবগাহন করে কবি হলেন যৌবন মদে মত্তা। যুগ যুগ ধরে জড়তাবদ্ধ বাংলার পয়ার লাচারির ধীর-মন্থর গতিতে আনলেন উজান স্রোতের প্রবল প্রবাহ। রূপে ও ভাবে সৃষ্টি করলেন নতুন গতিছন্দ। মেঘনাদ বধ কাব্যে আনলেন ইউরোপীয় মহাকাব্যের হেক্টর ও তার পত্নী অ্যান্ড্রোমেকির আবহ। ফলে স্বামী সন্নিধানে যেতে সম্ভাব্য বাধার কথা শুনে মেঘনাদ পত্নী তেজস্বিনী বীরাঙ্গনা প্রমীলার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো : ‘কি কহিলি বাসন্তি,/ পর্বত বাহিরায় যবে সিন্ধুর উদ্দেশ্যে/কার সাধ্য রোধে হেন গতি;/রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,/আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে?’

চিরাচরিত রক্ষণশীল বাঙালি হিন্দু সমাজ সেদিন রোধ করতে পারেনি পাশ্চাত্য আদর্শে দীক্ষিত কবি মাইকেল মধুসূধন দত্তকে। স্বদেশ প্রেমের দীক্ষাপ্রাপ্ত নতুন চিন্তা-চেতনার দিগন্তকে কবি উন্মোচন করলেন শুধু ছন্দে নয়, ভাবেও। কবি অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে পরাধীন ভারতে দেশপ্রেমের নতুন আবহ সৃষ্টি করলেন পররাজ্য আক্রমণকারী রামের বিরুদ্ধে স্বদেশ প্রেমিক রাবণের সার্থক উক্তির মধ্য দিয়ে: ‘জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে,/যে ডরে, মূঢ় সে ভীরু, শত ধিক তারে।’

কিন্তু পরবর্তী সময়ে মাইকেলের এই জীবনবাদের দীক্ষা গ্রহণ করার মতো কোনো যোগ্য উত্তরসূরি বা শিষ্য সেদিন পাওয়া যায়নি। ফলে অচিরেই মাইকেল মধুসূধন দত্ত প্রদর্শিত ওজস্বিনী ছন্দ এবং নতুন জীবন ভাবনা, ললিত গীতির সুর-মূর্ছনার বৈরাগ্যময় ছন্দের স্পর্শ লেগে ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। অতঃপর প্রায় অর্ধশত কিংবা তারও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এরপর বিশ শতকের উষালগ্নে পরাধীন ভারতের চেতনাদীপ্ত সংগ্রামী জনতা কবির কণ্ঠে চাইলেন আন্দোলন ও সংগ্রামের জন্য নতুন ভাষা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ গাইলেন: ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা/ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,/আধমরাদের ঘা দিয়ে তুুই বাঁচা।’
প্রতীয়মান হয়, প্রত্যাশিত ভাষা মিলল না। অসংকোচে কবিগুরু নিজেই জানালেন সে অক্ষমতার কথা: ‘আমার কবিতা জানি আমি/গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী;/যে আছে মাটির কাছাকাছি/সে কবির লাগি, আমি কান পেতে আছি।’
ইতোমধ্যে বিশ শতকের উষালগ্নে (১৯১৪ – ১৯১৮) বিশ্বের প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। বাঙালি যুবক কাজী নজরুল ইসলাম ৪৯ বাঙালি পল্টনভুক্ত হয়ে যোগ দিলেন এই যুদ্ধে। বাঙালি জাতির যুবকদের লক্ষ্য করে কবি তারস্বরে হাঁকলেন:’ওরে আয়/মহাসিন্ধুর ওপার থেকে/ঘন রণ ভেরি শোনা যায়,/ওরে আয়।’

চিত্রিত করলেন বাংলা সাহিত্যে প্রথম যুদ্ধ চিত্র ‘ভার্দুন ট্রেঞ্জ ফ্রাঞ্চ’। যুদ্ধক্ষেত্রের এক অভিনব ও অভূতপূর্ব রোমাঞ্চকর বর্ণনা। সৈনিক হলেন কবি। পাশে যুদ্ধরত তরুণ সৈনিক শত্রুর মেশিনগানের গুলি বুকে ধারণ করে মরে পড়ে আছে। বুকে তার রক্তগোলাপ। সৈনিক কবি লিখছেন, ‘আহা কি সুন্দর এই তরুণের মৃত্যুমাধুরী!/ চারিদিকে মেশিনগান, মর্টার চলছে, ধূলি ও ধুঁয়ায় চতুর্দিক আচ্ছন্ন।’

যুদ্ধান্তে ১৯১৮ সালের পর, হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফিরলেন একদা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা মহানগরীতে। এই মহানগর কলকাতা তখন ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলন, সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ। সারা ভারতজুড়ে চলছে গান্ধীজির চরকা আন্দোলনসহ অসহযোগ আন্দোলন, স্বরাজ আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি। ১৯২২ সালে সহসাই কবিকণ্ঠে বেজে উঠল অগ্নিবীণা: ‘আমি স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু/আমি বার বার আসি,/আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু।’

এক বিদ্রোহী কবিতা দিয়েই কবি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন বাঙালি সমাজে। অতঃপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক জীবনমুখী কাব্য, কবিতা, সংগীতে, নাটকে, উপন্যাসে, গজল, গানে ও শ্যামা সংগীতে ভরে তুললেন বাংলা সাহিত্যের আঙিনা। সংগ্রামী জনতাকে দিলেন তাদের প্রত্যাশিত সংগ্রামের ভাষা। লিখলেন আনন্দময়ীর আগমনে। সরকারি রোষে পতিত হলেন কবি। অতঃপর গ্রেপ্তার হলেন তিনি। কবির ওপর চলল নানা জুলুম, অত্যাচার। কারাগারে বসেই কবি গাইলেন শিকল ভাঙার দুর্বার সংগীত: “কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট, রক্ত-জমাট/ শিকল পূজার পাষাণ বেদী,/যতসব বন্দিশালা, আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা,/ ফেল উপাড়ি’। কবি আরও লিখলেন- ‘আমি হল বলরাম স্কন্ধে/উপাড়ি ফেলিব/অধীন বিশ্ব সৃষ্টির মহানন্দে।’

অতঃপর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের অসহনীয় অত্যাচার আর নিপীড়নে বেদনাদগ্ধ হয়ে কবি আমরণ অনশনে ব্রতী হলেন। কবি ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র বিপ্লব কামনা করেছিলেন। এখানে কবি গান্ধীদের চরকা আন্দোলন পছন্দ করেননি। কবি এসেছিলেন মহাবিপ্লব হেতু। কবি লিখলেন, ‘দস্তা নয় সে সস্তা নয়, আজাদী মেলে না চাস্তানোয়।’

তৎকালীন সশস্ত্র বিপ্লবের কর্ণধার বিপ্লবী বারীন ঘোষের মতাদর্শে দীক্ষা নিলেন কবি। তিনি নিখিল বঙ্গের যুবশক্তির উত্থান চাইলেন। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েও সামান্যতম সাড়াও পেলেন না কবি যুবশক্তির কাছ থেকে।

অতঃপর অন্তহীন দুঃখ, বেদনা, হতাশা ও অভিমানে কবি চিরবিদায় নিলেন সকল সংগ্রাম, সকল বিদ্রোহ ও সকল সাহিত্য সাধনা থেকেও। কবি দারুণ হতাশা ও অভিমানে সবাইকে জানিয়ে দিলেন:’শক্তিসিন্ধু মাঝে রহি হায়/শক্তি পেল না যে,/মরিবার বহু পূর্বে জানিয়ো/মরিয়া গিয়াছে সে।’

মাত্র দু-দুটো মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী বিশ বছরেরও কম সময়ের সাহিত্য সাধনা কবির। কিন্তু চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়- দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তত হয়ে মূক ও বধির হয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় কেটে গেল ত্রিশ বছরেরও অধিক সময়। কী নিদারুণ অপচয় কবি প্রতিভার। পল্লিকবি জসীম উদ্‌দীন দুঃখ করে বলেছেন, ‘জাপানী কবি নোগুচি যদি সমকালীন সময়ে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন, তাহলে আমাদের অধিকতর প্রতিভাবান কবি কেন তা পেতে পারলেন না।’ এর জন্য তিনি দুটি কারণ বড় করে দেখেছেন। তার একটি হচ্ছে- কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, আর দ্বিতীয়ত, তৎকালে বাঙালি মুসলমানদের প্রচারের জোর ছিল না।

পরশ পাথরে বিশ্বাস করতে বলি না কিন্তু এর গুণ তো কখনও কখনও ব্যক্তির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। কবি কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে সেই পরশ পাথরের গুণ তো বিদ্যমান ছিল। কবির স্পর্শে সহসাই বহু যুগের ক্লেদ কালিমা দূরীভূত হওয়ার জন্য দুয়ার খুলে যেত। অভূতপূর্ব প্রাণশক্তি ছিল কবির। সমসাময়িক এক কবি তার সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘ভায়া লাফ দেয় তিন হাত, গান গায় দিনরাত।’

কবির ১২২তম জন্মদিনে তার অযুত-লক্ষ ভক্ত এই ভেবে সান্ত্বনা পাবেন যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষণিকের জন্যও ভোলেননি যৌবনে দেখা জাতীয় জাগরণের চারণ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মাত্র ২-৩ মাসের মধ্যেই কবিকে ভারতের কলকাতা থেকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। কবিকে ভূষিত করলেন জাতীয় কবির মর্যাদায়, মাসোয়ারা বরাদ্দ করেন এবং বসবাসের জন্য প্রদান করলেন ধানমন্ডিতে এক সুদৃশ্য দ্বিতল ভবন।

লেখক: শিক্ষাবিদ