ইতালির ফুটবল ক্লাবে খেলতেন গাদ্দাফিপুত্র

প্রকাশিতঃ 11:22 am | May 28, 2021

স্পোর্টস ডেস্ক, কালের আলো:

বাবা ছিলেন লিবিয়ার স্বৈরশাসক। কিন্তু তার ইচ্ছে ছিল ফুটবলার হওয়ার। সে লক্ষ্যে ইতালির ফুটবল ক্লাবে যোগও দিয়েছিলেন লিবিয়ার শাসক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির ছেলে আল সাদি গাদ্দাফি।

তাঁর সঙ্গে চুক্তি করে বিশ্বজুড়ে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ইতালির প্রথম সারির ফুটবল ক্লাব পেরুজা।

তবে সেভাবে কোনো খেলায় সাদিকে নেয়া হয়নি। মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি।, তাও আবার বদলি খেলোয়াড় হিসেবে।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাপক প্রচারণা পাওয়ার জন্যই পেরুজার মালিক লুচিয়ানো গাউচি গাদ্দাফিপুত্রের সঙ্গে এই চুক্তিটি করেছিলেন।

তবে খেলার চেয়েও সাদি আল গাদ্দাফি বেশি আলোচিত হয়েছিলেন মাঠের বাইরে, বিশেষ করে তার প্লেবয় লাইফ-স্টাইল এবং লাগামহীন খরুচে স্বভাবের কারণে।

বিবিসি জানায়, ২০০৩ সালের গ্রীষ্মকালে ইতালির প্রথম সারির ফুটবল ক্লাব পেরুজা মওসুম শুরু হওয়ার আগে ফুটবলারদের অনুশীলন ক্যাম্প শুরু হয়।

রেলিগেশন এড়ানোর জন্য খেলোয়াড়েরা কঠোর পরিশ্রম করছিলেন। কিন্তু ওই বছর পেরুজার টিম ছিল বেশ শক্তিশালী। দলে অভিজ্ঞ ফুটবলার যেমন ছিলেন তেমনি বেশ কিছু নতুন খেলোয়াড়ও ছিলেন। এসব খেলোয়াড়ের লক্ষ্য ছিলো আরো বড়ো ক্লাবে যাওয়া। এক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করতে চাইছিলেন তারা।

পেরুজার ফরোয়ার্ডে খেলতেন ২১ বছর বয়সী জে বথরয়েড। তিনি গেছেন ইংল্যান্ড থেকে, বলেন, এই ক্লাবে ভালো ভালো ফুটবলার ছিল। এটা ছিল একটা পরিবার-কেন্দ্রিক ক্লাব।

পেরুজার গোলরক্ষক ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার জোকো ক্যালাচ। তার ভাষ্য, আমরা সবাই খেলছিলাম টিকে থাকার জন্য। সেরিয়াতে টিকে থাকতে পারাটাই আমাদের জন্য ছিল লিগের শিরোপা জেতার মতো।

আর ওই সময়ই পেরুজায় নতুন একজন ফুটবলার নেওয়া হয়। তার নাম সাদি আল গাদ্দাফি।

আধুনিক ফুটবলের ইতিহাসে তাকে দলে নেওয়া ছিল অস্বাভাবিক এক ঘটনা। কারণ তার বাবা তেল সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি।

আল সাদি পরিচিত ছিলেন শুধু সাদি নামেই। ফুটবল খেলতে ভালবাসতেন তিনি। ক্লাবে যোগ দেওয়ার অল্প কদিনের মধ্যে তিনি জে বথরয়েডসহ সব ফুটবলারের সঙ্গেই ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।

এ বিষয়ে জো বথরয়েড বলেন, আমরা দুজন ইংরেজিতে কথা বলতাম। সাদি ছিল মৃদুভাষী। খুব শান্ত এবং উদার প্রকৃতির মানুষ।

‘তবে তার পিতা লিবিয়ার লোকজনের প্রতি যে আচরণ করেছেন তার জন্য আমি গাদ্দাফিকে ক্ষমা করতে পারি না,’ বলেন তিনি।

ক্লাবের গোলকিপার জোকো ক্যালাচের সঙ্গেও সাদির বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে। একদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সাদি একটা জায়গায় বসেছিল। সে হয়তো ক্লান্ত কিংবা কোনো বিষয় নিয়ে মন খারাপ করেছিলো। আমি জানতে চাইলাম সে এখানে কী করছে।

“কয়েক ঘণ্টা পর তার দেহরক্ষীরা আমার রুমের দরজায় নক দিল। বলল যে, সাদি তার রুমে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি ভাবলাম এখানেই হয়তো আমার জীবনের শেষ। তার সঙ্গে আমার কথাবার্তা হলো। পরে সে বললো যে এই প্রথম কেউ তার সঙ্গে এতোটা খোলামেলা কথা বলেছে। সেদিনের পর থেকে আমরা দুজন ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম।”

সাদি আল গাদ্দাফি খুব একটা ভালো ফুটবলার ছিলেন না। তবে নিজেকে উন্নত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছিলেন তিনি।

জোকো ক্যালাচ বলেন, অনুশীলনের সময় যদি কারো সামনে পড়ে যান, আপনি হয়তো লাথি খেতে পারেন। তারপরেও আপনি খেলা চালিয়ে যাবেন। সাদিও এটা মেনে নিয়েছিল। অন্যরাও বোকা ছিল না। তারা জানতো যে তার দেহরক্ষীরা কার পার্কে বসে আছে।

‘তবে সাদি যে লিবিয়ার বাইরে – এটাই ছিল তার জন্য বড় ধরনের স্বাধীনতা। সে একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারছিল। আর দশজনের মতো চলাফেরা করলেও তার ছিল প্রচুর অর্থ,’ যোগ করেন তিনি।

বিলাস বহুল জীবন যাপনের কারণে মাঠ থেকে বাইরেই বেশি আলোচনা চলতো। একদিনের ঘটনা উল্লেখ করে জো বথরয়েড বলেন, সে (সাদি) একদিন আমাকে কল করলো। জানতে চাইল-আমি তার সঙ্গে শপিং-এ যেতে চাই কিনা! আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আমরা তখন একটা এয়ারপোর্টে চলে যাই। সে তখন বললো কেনাকাটার জন্য সে আজ মিলানে যাবে।’

‘তার একটা ব্যক্তিগত জেট ছিল। সেটা দিয়ে আমরা মিলানে চলে গেলাম। সেখানে তার এক বন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। ওই পার্টিতেই আমার স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম দেখা। সাদি প্রচুর খরচ করতো। তার সঙ্গে থাকতো একজন সুটকেস-ধারী ব্যক্তি যাতে প্রচুর নগদ অর্থ থাকতো,’ বলেন তিনি।

এমন কি জো বথরয়েডের বিয়ের সব খরচও দিয়েছিলেন সাদি আল গাদ্দাফি। এভাবেই দু হাতি অর্থ ব্যয়ের কথা জানালেন ক্যালাচও।

বিবিসি জানায়, আল সাদি কিন্তু তখনও পেরুজার হয়ে কোনো ম্যাচে খেলার সুযোগ পাননি। কিন্তু ২০০৪ সালে পেরুজা যখন জুভেন্টাসের মুখোমুখি হলো তখন তার জীবনে আসে বড় পরিবর্তন।

পেরুজা এক-শূন্য গোলে এগিয়ে গেল। তারপর জুভেন্টাসের একজন খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখিয়ে বের করে দেওয়া হলো মাঠের বাইরে। আহত হলেন জো বথরয়েড। তখন সাদিকে মাঠে নামানোর দারুণ সুযোগ পেয়ে গেলেন পেরুজার ম্যানেজার। শেষ পর্যন্ত ওই ম্যাচে জয়ী হলেন তারা।

এটাই ছিল পেরুজার হয়ে সাদির একমাত্র ম্যাচ। তবে ক্লাবের অন্যান্য খেলোয়াড়ের জন্য ছিল একটা বোনাসের মতো।

জো বথরয়েড বলেন, কারো যখন খেলায় অভিষেক হয় তখন সে সবাইকে খাওয়াতে নিয়ে যায়। সাদির অভিষেক হওয়ার পর সে সবাইকে মার্সিডিজ গাড়ি কিনে দিতে চেয়েছিলো।

সাদির পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু ইতালির আরো কিছু ক্লাবেও গিয়েছিলেন তিনি। খেলেছিলেন আরো একটি ম্যাচ। তারপর ২০০৭ সালে লিবিয়ায় ফিরে যান সাদি।

কিন্তু ২০১১ সালে গাদ্দাফির পরিবারের জন্য নেমে আসে খারাপ সময়। আরব দেশগুলোতে আরব বসন্তে’র হাওয়া লাগে লিবিয়ায়ও। ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায় এবং গাদ্দাফি সরকারের পতন ঘটে।

এরই মধ্যে গাদ্দাফিপরিবারের ব্যাপক দুর্নীতি আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা চলে আসে আন্তর্জাতিক আলোচনায়। ওই সময় সাদি শত শত প্রতিবাদকারীকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।

যদি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাদি। তিনি দাবি করেন, বিক্ষোভকারীরা পুলিশ স্টেশনে হামলা চালাতে শুরু করে। সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যায়। তখন আমাদের জন্য পরিস্থিতি খুব অনিরাপদ হয়ে পড়ে।

এদিকে ওই সময় সাদি সম্পর্কে যেসব খবর আসতে থাকে বাইরের দুনিয়ায় সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলো না তার সতীর্থ খেলোয়াড়দের।

জোকো ক্যালাচ বলেন, আমি তো সবকিছু জানতাম না। আমি তাকে একজন ব্যক্তি হিসেবে চিনতাম। আমার কাছে সে ছিলো বন্ধু।

পরে গাদ্দাফি সরকারের পতন ঘটে এবং গাদ্দাফি নিহত হন। লিবিয়া থেকে পালিয়ে যান সাদি।

কিন্তু ২০১৪ সালে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর থেকে তিনি দেশটির কারাগারে বন্দি। এ কথা সত্য যে, একসময় গাদ্দাফিপুত্র সাদি পেরুজার জার্সি পরে ফুটবল খেলেছেন তা অনেকের কাছেই এখন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।

কালের আলো/ডিডি/এমআরবি