টিকটক ফাঁদের মূল টার্গেট তরুণীরা

প্রকাশিতঃ 10:28 am | June 08, 2021

অপরাধ প্রতিবেদক, কালের আলো:

টিকটক ভিডিও আড়ালে সারাদেশে মানব পাচারের বিশাল নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। দেশের প্রতিটি জেলা, থানা, এমনকি গ্রাম পর্যায়ে রয়েছে এই চক্রের নেটওয়ার্ক। সারাদেশে চক্রের সক্রিয় পাঁচ শতাধিক সদস্য তরুণীদের টার্গেট করেই নারী পাচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, টিকটক ভিডিও তৈরি ও তরুণীদের মডেল বানানোর টোপ দিয়েই আকর্ষণ করে চক্রটি। পরে বিভিন্নভাবে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার চক্রের সদস্যরা নারী পাচারের বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তদন্ত শুরু করেছে।

জানা যায়, সম্প্রতি ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশি তরুণীকে বিবস্ত্র করে কয়েকজন যুবকের যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরালের ঘটনার হোতা আশরাফুল মণ্ডল ওরফে বস রাফি তার সহযোগী সাহিদা বেগম ওরফে ম্যাডাম সাহিদা, ইসমাইল সরদার, আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখকে যশোর ও বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

এরপর ভারতে পাচার হওয়ার ৭৭ দিন পর কৌশলে দেশে ফিরে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় এক তরুণীর মানবপাচার ও পর্নোগ্রাফি আইনে করা মামলায় গত ১ জুন সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়ার কালিয়ানী এলাকা থেকে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের এই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এছাড়া রাজশাহীতে টিকটক ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে ছাড়ার প্রস্তুতির ঘটনায় তিন তরুণীসহ আরও ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এদিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের গ্রেপ্তাররা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাচারের শিকার নারীদের সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, শ্রীপুর উপজেলার জৈনা বাজার এলাকার একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার দরিদ্র পরিবারের দুই তরুণী। কারখানার পাশেই একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তারা। সেখানেই কয়েকজনের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়, যারা টিকটক চক্রের নারী পাচারকারী চক্রের সদস্য।

চক্রের সদস্য সুজন নিজেকে নেত্রকোনার ও অপরজন ইউসুফ ময়মনসিংহের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিয়ে দুই বোনের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে বিশ্বাস অর্জনের জন্য পাশাপাশি বসবাস, দেখা-সাক্ষাৎ করেন তারা। একপর্যায়ে বড় বোনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ইউসুফের। মাসে ৫০ হাজার টাকা আয়ের লোভ দেখিয়ে তারা দুই বোনকে নিয়ে টিকটক ভিডিও বানায়।
এরপর জীবননগর সীমান্ত দিয়ে ভারতের রানাঘাট এলাকায় নিয়ে দুই বোনকে ৩ লাখ টাকায় নারী কারবারিদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

এ বিষয়ে পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা কালের আলোকে জানান, পশ্চিমবঙ্গের দিঘা এলাকার বিভিন্ন বাসায় ও হোটেলে রেখে ওই দুই তরুণীকে দিয়ে দেহ ব্যবসা চালানো হচ্ছিল। তবে করোনার প্রাদুর্ভাবে গত ১৬ মে লকডাউন শুরু হওয়ার পর পাচারকারীদের নজরদারি এড়িয়ে দুই বোন পালিয়ে যায়। শিয়ালদহ এলাকায় ভারত সরকার পরিচালিত সেফ হোম পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠানে এক বোন, আরেক বোন রয়েছে ভারতের বোঝাপড়া সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের সাউথ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের কাছে। তারা এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে ভারতে পাচার হওয়া এক তরুণী ৭৭ দিন অমানুষিক নির্যাতনের পর গত ৭ মে দেশে পালিয়ে এসে ১ জুন হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। ওই সময় পুলিশ জানায়, ওই নারীকে পাচারে জড়িত ১২ জন। তাদের মধ্যে ভারতীয় সাতজন, দেশীয় পাঁচ জন। পরে পুলিশ পাঁচ জনের মধ্যে মেহেদি হাসান, মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদের নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে ৫ দিনের রিমান্ড নিয়েছে। তারা পুলিশের কাছে দোষ স্বীকার করেছে। একই সঙ্গে ওই কিশোরীসহ প্রায় দেড় হাজারের বেশি নারীকে ভারতে পাচার করার কথা জানিয়েছে তারা।

পুলিশ সূত্র জানায়, দেশ থেকে পাচার হওয়া তরুণীদের অধিকাংশকেই ভারতের বিভিন্ন শপিংমল-সুপারশপে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এর বাইরে প্রেমের অভিনয়-টিকটক সুপারস্টার বানানোর কথা বলেও তরুণীদের নিয়ে যান কথিত টিকটক স্টার ও নারী পাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য রিফাদুল ইসলাম হৃদয়।

টিকটকে পরিচয়ের সূত্রধরে ঘনিষ্ঠতা, বিশ্বাস অর্জন তারপর পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে তার পাচার প্রক্রিয়া। এর বাইরে প্রয়োজনে ভারতে গিয়ে কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও এ চক্রের হাতে পাচার হয়েছেন অনেকে- এমন ঘটনাও ঘটেছে।

নজরদারিতে অপরাধীরা
সম্প্রতি ভারতে এক বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় তদন্ত করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক নারীপাচার চক্রের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, কুরুচিপূর্ণ ভিডিও বানিয়ে অশ্লীলতা ছড়ানোর অভিযোগে কয়েকশ টিকটকারকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে পুলিশের সাইবার ইউনিট।

তিনি বলেন, টিকটকের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এই পাচারকেন্দ্রিক অপচেষ্টা শুরু হয়। উঠতি বয়সী কিশোরী-তরুণীদের মডেল বা স্টার বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে পাচার করছে একাধিক চক্র। এজন্য আমরা টিকটককে নেগেটিভলি দেখছি। টিকটককেন্দ্রিক অপচেষ্টা বন্ধে আমরা জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।

এক প্রশ্নের উত্তরে ডিএমপির ডিসি মো. শহিদুল্লাহ জানান, পাচারের শিকার ও পাচারকারীরা অবৈধভাবে ভারতে যায়। ফলে তাদের কাছে ভিসা-পাসপোর্ট বা কোন ধরনের বৈধ কাগজপত্র থাকে না। এরপর চক্রের ভারতীয়দের সহায়তায় সে দেশের আধারকার্ডের ব্যবস্থা করা হয়। সেই কার্ড ব্যবহার করে তারা ভারতে চলাফেরা করে থাকেন। তদন্তের এ পর্যায়ে আমরা অনেকের নাম পেয়েছি।
এ বিষয়ে আরও অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কালের আলো/এমএম/বিএসকে