কষ্টের দিন শেষে এখন তারা নারী উদ্যোক্তা

প্রকাশিতঃ 2:09 pm | June 08, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

শিরিন আক্তার, জন্ম বগুড়ার গাবতলী উপজেলার দুর্গাঘাটা ইউনিয়নের দুর্গাহাটা গ্রামে। কৈশোর না পেরুতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় শিরিনকে। স্বামী ছিল বেকার, কিন্তু শ্বশুরের সহায়-সম্পত্তি দেখেই তাকে একরকম জোর করেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেন শিরিনের বাবা।

বিয়ের শুরুটা ভালো হলেও, সমস্যা সৃষ্টি হয় এক বছর পরই। তখনও শিরিনের স্বামী মিঠুর চাকরি কিংবা কোনো কাজ জুটেনি। এর মাঝেই তাদের পৃথকভাবে থাকার জন্য বলেন তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি।

দুই চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলেন শিরিন। স্বামীর কোনো কাজ নাই, ঘরে চাল নেই। পকেটও শূন্য। কীভাবে সংসার চালাবেন, সেই চিন্তায় অন্ধকার নেমে আসে তাদের জীবনে। এক বেলা খাবার জোটে তো, পরের বেলা উপোস।

এভাবেই চলে যায় কয়েক বছর। এর মাঝে স্বামী মিঠু ছোট-খাট কাজ করেন, তখন কোল আলো করে আসে এক মেয়ে। নাম রাখেন সুমাইয়া আক্তার মীম। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেন, কিন্তু টিফিন কিংবা স্কুলে যাওয়ার যাতায়াত ভাড়া দিতে পারতেন না।

তবে এখন আর অর্থকষ্ট নেই শিরিনদের। দিন বদলে গেছে। পরিশ্রম করে ভাগ্যকে বদল করেছেন তিনি। কৃষিপণ্য উৎপাদন করে তা বাজারে বিক্রি করেন। এতে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে এবং সঞ্চয়ও করতে পারেন তিনি।

জানা যায়, গ্রামীণ নারীদের মূলস্রোতে সংযুক্ত করতে এবং উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ২০১৫ সালে ‘মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ)’ শীর্ষক প্রকল্প চালু করে বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড। স্থানীয়ভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসিয়াব।

শিরিন জানান, সংসার যখন চলে না কোনো পরিকল্পনা কিংবা চিন্তা-ও মাথায় আসে না। এরপরও পাশের বাড়ির এক স্কুল মাস্টার ভাবির পরামর্শে কৃষিপণ্য উৎপাদন শুরু করি। এর মাঝে নারীর জন্য বাজার তৈরি শীর্ষক প্রকল্প বগুড়ার গাবতলীতে বাস্তবায়ন শুরু হলে আমিও সেখানে নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করি।

‘ওই প্রকল্পের অধীনে কৃষিপণ্যের আধুনিক উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাপনার ওপর ধারাবাহিক ট্রেনিং নিই। এতে আমি লাভবান হয়েছি।’

শুধু শিরিন-ই নন, কৃষিপণ্য সংগ্রহ কেন্দ্রভিত্তিক নারীবান্ধব উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় নতুন ভাবনার আলোকে দুর্গাহাটা ইউনিয়নের আরও ২০০ নারী স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। শিরিনের ভাষ্য, কিছুই ছিল না। সেখান থেকে নিজের আয়ে ৪ শতাংশ জমি কিনেছি। মেসার্স মীম স্টোর নামে একটি দোকান দিয়েছি। এখন ভালো চলছে সংসার।

শিরিন নিজে উদ্যোক্তা হয়েছেন। এখন কাজ করছেন ইউনিয়নের অন্যান্য নারীদের উদ্যেক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে। বর্তমানে দুর্গাঘাটা ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। ভবিষ্যতে তৃণমূল নারীদের আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখেন পঞ্চম শ্রেণি অবদি পড়া শিরিন।

একটা সময় অন্যের জমিতে কাজ করতেন গাবতলী উপজেলার নেপালতলী ইউনিয়নের সুরাইয়া আক্তারের স্বামী আবদুল আলিম। সুরাইয়া এখন নারী উদ্যোক্তা, শাখ-সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন।

‘নিজের ভিটেমাটি ছিল না, এখন ১২ বিঘা জমি করেছি আল্লাহর রহমতে,’ বলছিলেন সুরাইয়া। সারাবছরই নানা ধরনের সবজির আবাদ করেন তিনি। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে স্থানীয় বাজারে মার্কেটের শেড পরিচালনা করছেন সুরাইয়া। তিনি বলেন, আমি এখন সরাসরি আড়ৎদারদের কাছে পণ্য বিক্রি করি।

‘কিন্তু একটা সময় বাজারে বসা নিয়ে কটু কথাসহ নানা কুসংস্কার শুনতে হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, মেয়েরা যেন বাজারে না বসে। ঘরের বউ যেন ঘরেই থাকে। অসংখ্য কটূক্তি শুনতে হয়েছে। তবে সে অবস্থা অতিক্রম করেছি আমরা,’ যোগ করেন সুরাইয়া।

কৃষিজাত পণ্যের পাশাপাশি দেশি মুরগি বিক্রি করেন তিনি। তার এখানে ডিমও পাওয়া যায়। নিজের প্রায় দেড় বিঘা জমিতে পেঁপে চাষ করেন। তার আবাদ করা ফসল বছরে বিক্রি করেন ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। উৎপাদন ব্যয় বাদে লাভ থাকে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। পাঁচ থেকে সাতজন শ্রমিক কাজ করেন তার জমিতে।

তিনি জানান, কৃষি পণ্য উৎপাদনের ফলে কৃষি কর্মকর্তারাও কৃষিপণ্য সংগ্রহ কেন্দ্রে বসে নারী-পুরুষ সব কৃষককে কৃষি বিষয়ে নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে এর মাধ্যমে হাঁস-মুরগি এবং গরু-ছাগলের বিভিন্ন টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করে, পরিবার পরিকল্পনা অফিস টিকাদান কেন্দ্র ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদান কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে।

কৃষিপণ্য বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন উপকরণ কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদন পদ্ধতি, উপকরণ প্রয়োগ মাত্রা, কোন ক্ষেত্রে কোন বালাইনাশক কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে- এরূপ নানা বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন সংশ্নিষ্টরা। ‘কালেকশন পয়েন্ট’ এখন ‘বিজনেস রিসোর্স সেন্টার’ বা বাণিজ্যিক সম্পদ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রকল্প সম্পর্কে অ্যাকশনএইডের এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের সিনিয়র অফিসার (অ্যাডভোকেসি) জাকিরুল ইসলাম জানান, এ প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের জন্য গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজে বিক্রয় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রকল্পের আওতায় কমিউনিটি পর্যায়ে ৬৭টি নারীবান্ধব কালেকশন পয়েন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে নারীদের প্রবেশকে উৎসাহিত করার জন্য বাজারে নারীবান্ধব ২২টি মার্কেট শেড নির্মাণ করা হয়েছে।

‘ওইসব কালেকশন পয়েন্ট ও মার্কেট শেডগুলোতে নারীদের সুবিধার্থে টয়লেট, নলকূপ, ব্রেস্ট ফিডিং কর্নারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদের বাণিজ্যিকভাবে কৃষিপণ্য উৎপাদন, আধুনিক বাজারজাতকরণ পদ্ধতি এবং ভ্যালু চেইন বিশ্নেষণসহ সংশ্নিষ্ট নানাবিধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ফলে প্রকল্প এলাকার নারীদের কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং বাজারে তাদের প্রবেশ বৃদ্ধি পেয়েছে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে জাকিরুল ইসলাম জানান, নারী উদ্যোক্তারা স্থানীয় পর্যায়ের পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে কালেকশন পয়েন্টের মাধ্যমে তাদের উৎপাদিত অধিকাংশ পণ্য রাজধানীর ফার্মগেটের পাইকার বা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। ফলে তাদের পণ্য বিক্রি পরিবহন খরচ লাগছে না, খাজনা দিতে হয় না, পণ্য বিক্রয়ের নিশ্চয়তা থাকছে, বিক্রয়ে সময় কম লাগে, যা তারা কৃষি কাজে অথবা বাড়ির অন্যান্য কাজে ব্যয় করতে পারেন।

তিনি বলেন, কালেকশন পয়েন্টকে তারা উৎপাদন ও বিপণন সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ ও সেবা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন। অন্যদিকে গ্রামীণ নারী কৃষি-উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের কিছু অংশ মার্কেট শেডের মাধ্যমেও ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করছেন। আবার গ্রামীণ নারী কৃষি-উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে তাদের উৎপাদিত পণ্য অন্য নারীরা কিনে স্থানীয় বাজারের মার্কেট শেডের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করছেন।

প্রকল্পের সমন্বয়ক ড. শওকত আকবর ফকির বলেন, গ্রামীণ এলাকায় নারী কৃষি-উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, পারিবারিক সম্পদের ওপর মালিকানাসহ নারীর অন্যান্য অধিকার অর্জনকে ত্বরান্বিত করা যায়। এটা জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

এ লক্ষ্যে ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে এই প্রকল্প শুরু হয় জানিয়ে তিনি বলেন, যে উদ্দেশ্যে এ প্রকল্প শুরু হয় তার অনেকটাই অর্জিত হয়েছে। এমনকি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও কৃষি খাতে নারীবান্ধব বাজার ব্যবস্থা নিয়ে আমরা কাজ করেছি। প্রকল্পটি নারী উদ্যোক্তাবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং জয়িতা ফাউন্ডেশনের সঙ্গেও কাজ করছে।

‘এ প্রকল্পের মাধ্যমে এ মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে,’ বলেন অ্যাকশন এইডের এই কর্মকর্তা।

কালের আলো/এমএ/এমএইচএ