রসনাবিলাসে অষ্টগ্রামের পনির

প্রকাশিতঃ 12:14 pm | June 16, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

কিশোরগঞ্জের হাওর জনপদ অষ্টগ্রাম। মূল ভূখণ্ডে দত্তপাড়া নামে একটি বসতি অঞ্চল ছিল। বিস্তৃর্ণ হাওরের গবাদিপশু পালনের অনুকূল পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে দত্তপাড়ার কয়েকজনের হাতে তৈরি হয় পনির। বর্তমানে পনির দুগ্ধজাত খাবারটি বাণিজ্যিক সম্ভাবনা জাগিয়ে দিয়েছ।

এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, ঐতিহ্যের এই গল্প অন্তত ৩০০ বছর আগের, মুঘল আমলের। এক সময় অষ্টগ্রামের পনিরের সুনাম ছিলো দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। তবে এখন সেভাবে না থাকলেও পনিরের স্বাদ কমেনি।

সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে এবং পনির তৈরিতে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলা রয়েছে। জেলার তিনটি হাওর উপজেলার একটি অষ্টগ্রাম। হাওরের অর্থনীতি কৃষি ও মৎস্য–নির্ভর। এই জনপদের জমি এক ফসলি। বর্ষার বিস্তৃর্ণ জলরাশি আর গ্রীষ্মে ফসলি মাঠ—এই হলো হাওরের বৈশিষ্ট্য।

চারণভূমি আর সবুজ ঘাসের সমারোহের কারণে হাওরে পর্যাপ্ত গরু ও মহিষের পালন হয়। হাওরের গবাদিপশুর দুধের গুণগত মান উৎকৃষ্ট। পনির তৈরির প্রধান উপাদান দুধ। সেই কারণে অষ্টগ্রামে পনির তৈরির কাঁচামালের অভাব হয়নি কখনো।

অষ্টগ্রামের কারবালাহাটি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সালাম। সালাম জানান, তার দাদা নূর আলী প্রথমে পনির তৈরি শুরু করেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত সালামের বাবা ফিরোজ আলীর আয়ের মাধ্যম ছিল পনির।

নানা চ্যালেঞ্জ স্বত্তেও বাবা-দাদার পেশা টিকিয়ে রেখেছেন সালাম। বলেন, আগের মতো রমরমা বা হলেও ব্যবসাটা ধরে রাখছি।

সাংবাদদিক ও উদ্যোক্তা গোলাম রসুল অষ্টগ্রামের বাসিন্দা। অষ্টগ্রামে উৎপাদিত এই পনির রাজধানীসহ দেশে-বিদেশে পাঠানোর কাজ করছেন।

তিনি বলেন, অষ্টগ্রামের কয়েকটি গ্রামে নিয়মিতভাবে পনির তৈরি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। আমি এই খাবারটি রাজধানীসহ বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করছি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অষ্টগ্রামের এই পনির যাচ্ছে বঙ্গভবন ও গণভবনেও। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের খাদ্যতালিকায় পনির অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত বছর একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী অষ্টগ্রামের পনির নিয়ে তাঁর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেন এবং বিদেশ রপ্তানির সম্ভাবনার কথা বলেন।

কিশোরগঞ্জের সাংবাদিক টিটু দাস বলেন, বর্তমানে পনিরের চাহিদা অনেক। এর মধ্যে কিছু ভোক্তার প্রধান আগ্রহ অষ্টগ্রামের পনিরে। কারণ, ওখানকার পনির জিবে জল আনে। বিশেষ করে দেশের কিছু ভিআইপির আকর্ষণীয় নজর আছে এখানকার পনিরের দিকে। ফলে অনেক সময় চাহিদার বিপরীতে জোগান দিতে কষ্ট হয়।

অষ্টগ্রামের পনিরের বিশেষত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে ব্যবসায়ী সালাম জানালেন, এখাকার গরু ও মহিষ বছরের বেশির ভাগ সময় সতেজ ঘাস খাওয়ার সুযোগ পায়। সেই দুধের কারণে ক্রিম থাকে প্রচুর। ফলে পনির তৈরির পর সুন্দর রং আসে এবং স্বাদেও ভিন্নতা থাকে।

জানা গেছে, বর্তমানে এক কেজি পনির তৈরি করতে ১০ কেজি দুধের প্রয়োজন হয়। হাঁড়িতে দুধ গরম করে ছানা করা এবং ছেঁকে পনির তৈরি করতে হয়। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ হয় ৬০০ টাকার মতো। ফলে ৭০০ টাকার নিচে বিক্রি করার সুযোগ থাকে না। কখনো কখনো এক হাজার টাকা কেজিদরে বিক্রি করা যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রাজধানী ঢাকা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ অষ্টগ্রামে উৎপাদিত পনিরের প্রধান বাজার। এখন অনলাইনেও বাজারের প্রসার হচ্ছে। অর্ডার আসছে মোবাইল ফোনে।

পনির তৈরি করে ভালো আছেন কারবালা হাটির রাসেল মিয়া। রাসেল জানালেন, ‘চাহিদা সব সময় এক থাকে না। কখনো কখনো আমাদের অর্থকষ্টে পড়তে হয়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে বাজারজাতের সমস্যা অনেক। তবে আশার দিক হলো, এখন যোগাযোগ সমস্যা কিছুটা কমে আসছে। অনলাইনেও এই ব্যবসার প্রসার ঘটছে। বিদেশ থেকে অর্ডার পাচ্ছি।’

রাসেলের বিশ্বাস, সুযোগ পেলে জিবে জল আসা অষ্টগ্রামের পনিরের স্বাদ দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে বিদেশেও প্রভাব ধরে রাখবে।

এদিকে দেশ ও বিশ্ববাজারে দিন দিন চাহিদা বাড়লেও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতার এই সময়ে অষ্টগ্রামের পনিরের প্রসার সংকুচিত হয়ে এসেছে।

অষ্টগ্রামের কারিগরদের বড় একটি অংশ এখন ঢাকা, চটগ্রাম ও সিলেটে স্থায়ী বসতি করে পনির ব্যবসা খুলে বসেছেন। তবে বড় একটি অংশ চলে গেলেও অষ্টগ্রামে পনির তৈরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বিলীন হয়ে যায়নি পেশার পরিবারগুলোও।

অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যে এখনো বেশ কয়েকটি পরিবার সম্পূর্ণ হাতে তৈরি করে পনিরের স্বাদ ও মান ধরে রেখেছে।

কিশোরগঞ্জ-৪ (অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন) আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, বঙ্গবভন ও গণবভনে প্রায় আমাদের পনির নিয়ে কথা হয়। গুরুত্বপূর্ণ লোকজন অষ্টগ্রামের পনির পেলে খেতে আগ্রহ দেখান। এটা বেশ আনন্দের।

পনির ব্যবসার সঙ্গে যুক্তদের কল্যাণে ভবিষ্যতে কিছু করার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।#

কালের আলো/ডিএবি/এমএম