সনাতনী ধারণা পাল্টে সংশোধনের পাঠশালা হচ্ছে কারাগার
প্রকাশিতঃ 9:57 am | June 22, 2021

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :
পাল্টে যাচ্ছে সনাতনী ধারণা। বদলে যাচ্ছে বন্দিশালার আবহ। ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ এই স্লোগানের বাস্তবায়ন করতেই চলছে বহুমুখী ও কার্যকর সব উদ্যোগ। ফলত শতাব্দীকালের পুরনো অনেক নিয়মই ঝেড়ে ফেলা হয়েছে। কারাগারগুলোকে সংশোধনের পাঠশালায় রূপ দিতেই চলছে তোড়জোড়।
কয়েদিদের দেওয়া হচ্ছে উপার্জনমুখী প্রশিক্ষণ। এতে স্বাবলম্বী হচ্ছেন তাঁরা। রুটি-গুড়ের ২০০ বছরের ইতিহাসের যবনিকাপাত ঘটেছে। সপ্তাহে দু’দিন খিচুড়ি পাচ্ছেন বন্দিরা। জুটছে উন্নত খাবারও। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন এই অধিদপ্তরকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত দুর্নীতিমুক্ত কারাগারের চ্যালেঞ্জে জয়ী হতেই নিজের বহুমুখী পরিকল্পনা সাজিয়েছেন কারা অধিদপ্তরের আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন। নতুন ভবন তৈরি থেকে শুরু করে মানসিকভাবে বন্দিদের অপরাধপ্রবণতাও দূর করতে নিরলস কাজ করছেন কারা কর্তৃপক্ষ।
প্রশিক্ষণে দক্ষ ও স্বাবলম্বী হচ্ছেন বন্দিরা
দেশের কারাগারগুলোকে সংশোধনাগারে রূপ দিতে বন্দিদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রতিটি হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। কর্মমুখী মানসিকতা গড়ার জন্য করা হচ্ছে কাউন্সেলিং। অপরাধের অন্ধকার সড়ক থেকে পা বাড়ানোর পথ বন্ধ করে আলোকিত জীবন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করা হচ্ছে।
কারা সূত্র জানিয়েছে, জুলাই/২০১৪ হতে ফেব্রুয়ারী / ২০২১ পর্যন্ত দেশের ৩০ টি কারাগারে ৩৮ ধরনের কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এতে ৫১,৭৮১ জন বন্দি প্রশিক্ষণ সুবিধার আওতায় এসেছেন। বন্দিদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য গাজীপুরের কাশিমপুর-২ কারাগারে বন্দি পুনর্বাসন প্রশিক্ষণ স্কুল চালু করা হয়েছে।
পুরুষ ও মহিলা কয়েদিদের তাঁত, রান্না, সেলাই, বুটিক, বাটিক, ইলেকট্রিক অ্যান্ড হাউস অয়্যারিং, লন্ড্রি, বেকারি, নার্সারি,পোশাক তেরী, জামদানি তৈরী,রেডিও-টিভি-ঘড়ি মেরামত, প্রেস ও বাঁধাই শিল্প,ব্যানার আর্ট ও ড্রইং, বিউটি পার্লার ও কুটির শিল্পের বিভিন্ন কাজ শেখানো হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণ নিয়ে কয়েদিরা কাঠ, বেত, বাঁশ, তাঁত, সুতা ও বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে তৈরি করছেন আসবাবপত্র, ছোট-বড় মোড়া, চেয়ার, ঝুড়ি, বাঁশের দোলনা, কলমদানি ও বেতের ঝুড়িসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ব্যবহারিক সামগ্রী।
পরিবর্তনের রূপ আইজি প্রিজন্সের কন্ঠে
দীর্ঘ বর্ণাঢ্য চাকরি জীবনে নানামুখী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন কারা অধিদপ্তরের আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন। এবার কারাগারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন। সাফ সাফ বলেছেন, কারাগার হবে দুর্নীতিমুক্ত এবং সংশোধনাগার।
কারাগারগুলোতে ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর কথা জানিয়ে আইজি প্রিজন্স কালের আলোকে বলেন, ‘অনেক কারাগার সংস্কার ও বর্ধিত করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে আটটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আরও ১৮ টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাইপলাইনে রয়েছে।’

তিনি জানান, ৪২৪৫০ বন্দি ধারন ক্ষমতার বিপরীতে বতর্মানে ৮২০০০ এর বেশি বন্দি আটক রয়েছে। অনুমোদিত ১২১৭৮ জন জনবলের বিপরীতে ১০১০১ জন কর্মরত রয়েছে এবং ২০৭৭ টি শূণ্যপদ রয়েছে।
মো. মোমিনুর রহমান মামুন আরও বলেন, ‘বিগত ২০০ বছরের ইতিহাস ছিল সকালে বন্দিরা নাস্তা করতো রুটি আর গুড় দিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বন্দিদের সকালের নাস্তায় এখন সপ্তাহে দু’দিন খিচুড়ি, একদিন হালুয়া-রুটি আর চারদিন সবজি-রুটি দেয়া হচ্ছে। বন্দিদের জন্য উন্নত খাবারের ব্যবস্থাও ছিল না। এখন বিশেষ দিনগুলোতে উন্নত খাবারের জন্য বন্দিপ্রতি ১৫০ টাকা বরাদ্দ আছে।’
আলাপচারিতায় কারাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন জানান, কারাগারে আটক বন্দিদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের বেতন ছিল প্রতি পরিদর্শনে ২০ টাকা। তা বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়েছে। বন্দিদের ইফতারের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৫ ( পনের) টাকা। সেটা এখন ৩০ টাকা। কারাগারে কয়েদি পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের মাসিক বরাদ্দ ছিল ২০ টাকা। সেটাও এখন ৫০০ টাকা হয়েছে। এছাড়াও আদালতগামী বন্দিদের দুপুরের খাবারের জন্য চিড়া গুড়ের পরিবর্তে শুকনো খাবার হিসেবে দৈনিক মাথাপিছু ২৬ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং বন্দিদের এক কারাগার হতে অন্য কারাগারে স্থানান্তরকালে দৈনিক খোরাকী ভাতা ১৬ টাকা হতে বৃদ্ধি করে ১০০ টাকা প্রদান কারা হচ্ছে।
আইজি প্রিজন্স বলেন, ‘বন্দিদের জন্য আগে বালিশ ছিল না। এখন ১ টি করে বালিশ দেওয়া হচ্ছে। কয়েদিরা ৩০ টি কারাগারে ৩৮ টি পণ্য উৎপাদন করে। এগুলো বিক্রির লভ্যাংশের ৫০ ভাগ বন্দিদের হিসাবে জমা হয়।’
পরিধি বাড়ছে কারাগারের গার্মেন্টসগুলোর
কেরানীগঞ্জ, কাশিমপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি কারাগারের গার্মেন্টেস’র পরিধি বাড়ানোর প্রচেষ্টার কথা জানিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান। তিনি বলেন, ‘৩৮টি ট্রেডে বন্দিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। বন্দিদের মধ্যে অনেক উপকরণ আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে দিচ্ছি।
প্রশিক্ষিত বন্দিদের সমাজকল্যাণ অধিদফতরের সার্টিফিকেট ও উপকরণ দেওয়া হচ্ছে। আহছানিয়া মিশনসহ অনেকে কাজ করছে। তারা প্রশিক্ষণ সামগ্রী দিচ্ছে।’
আইজি প্রিজন্স বলেন, ‘প্রিজনারস অ্যাক্ট সংশোধন ও এর বাংলায় রূপান্তর করার কাজ চলছে। এর নাম দেওয়া হচ্ছে ‘বাংলাদেশ প্রিজন্স অ্যান্ড কারেকশনাল সার্ভিস অ্যাক্ট’।’

ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলতে পারবেন বন্দিরা
করোনার জন্য স্বজনদের সঙ্গে বন্দিদের সাক্ষাত বন্ধ রয়েছে। প্রতিটি কারাগারে করোনা পরিস্থিতিতে প্রত্যেক বন্দি প্রতি সপ্তাহে এক দিন ১০ মিনিট করে পরিবারের সাথে মোবাইলে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন । এছাড়াও a2i প্রকল্পের সহযোগিতায় কারা অধিদপ্তরের নিজস্ব অর্থায়নে টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ‘স্বজন ’ নামে একটি প্রকল্পের কথা জানিয়ে কারাপ্রধান বলেন, ‘এর মাধ্যমে সহজেই বন্দিরা কথা বলতে পারে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বন্দিরা স্বজনদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সেও কথা বলতে পারবে।
অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ
কারাগারে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে গ্রহণ করা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান বলেন, ‘আমরা নিজেরা সংশোধিত হলে কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো। কারা অধিদপ্তরে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আমি কারাগারে সব রকমের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এ বিষয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কারারক্ষীদের সঙ্গে আলোচনা করছি। দুর্নীতি কেন হচ্ছে, সমস্যাটা কোথায়, সেটা বের করতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে আইজি প্রিজন্স আরও বলেন, ‘আমাদের একটি কারা গোয়েন্দা ইউনিট রয়েছে। তাদের সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। একইসঙ্গে অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছি। তাদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করি। বিশেষ বন্দি যারা থাকে, তারা কাদের সঙ্গে দেখা করেন, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেন, সে খবরও রাখার চেষ্টা করি।’
‘কারারক্ষীদের দুর্নীতি আমরা কারা গোয়েন্দাদের মাধ্যমেই সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। তাই কারা গোয়েন্দা ইউনিটকে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য তাদের আরও কীভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় সে চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের খুব ঘাটতি আছে। এটা করা হলে দুর্নীতি, অনিয়ম অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।’
[মুজিববর্ষ উপলক্ষে কালের আলোর বিশেষ প্রকাশনা ‘৫০ বছরে বাংলাদেশ; অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা’ শীর্ষক বিশেষায়িত প্রিন্ট ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া।]
কালের আলো/এমএএএমকে