বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রোকন উদ্দিন আহমেদের সন্তানই এখন দেশের সেনাপ্রধান

প্রকাশিতঃ 11:21 pm | June 25, 2021

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো :

ইতিহাসের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাংলাকে স্বাধীন করতে সেদিন মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন শেখ মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন আহমেদ। জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে ঝাঁপিয়ে পড়েন সংগ্রামে। নয় মাসের সংগ্রাম শেষে ওঠে সোনালী সূর্য। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত হয় চির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং গুরুত্বপূর্ণ তিন বার্তা নতুন সেনাপ্রধানের (ভিডিও)

এরপর কেটে গেছে ৫০ টি বছর। মুজিব শতবর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণটিতেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী, ঘনিষ্ঠ সহচর শেখ মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন আহমেদের রক্তের উত্তরাধিকার জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের কাঁধেই একটি পেশাদার, সুদক্ষ ও গৌরবমন্ডিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুরুদায়িত্ব তুলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি অভিষিক্ত হয়েছেন দেশের ১৭ তম সেনাপ্রধান হিসেবে।

নিজের সন্তানের জীবনের শ্রেষ্ঠ এ অর্জন দেখে যেতে পারেননি একাত্তরের রণাঙ্গণের বীর সেনানী শেখ মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন আহমেদ। কিন্তু দুরন্ত শৈশবেই অহঙ্কার আর গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনেছেন বাবার জবানীতেই। স্বাধীনতার অর্জনকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে নিতে আদর্শ ও ত্যাগের মহিমায় একটি জাতিকে নৈতিক চরিত্রে দাঁড় করাতে হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াসের মন্ত্রমুগ্ধ পাঠ নিয়েছেন জীবনের উষালগ্নেই।

আরও পড়ুন: প্রথম দিনটি যেভাবে কাটালেন সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ

বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেই জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ মুক্তিযুদ্ধে সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যার একক নেতৃত্বে সুচিত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং আমরা পেয়েছি আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা।’

মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে সবার দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেন জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

ইতিহাসের হীরকখচিত উজ্জ্বল বর্ণময় নন্দিত ইতিহাস রয়েছে নতুন সেনাপ্রধানের প্রয়াত বাবা শেখ মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন আহমেদ’র। একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা একজন অধ্যাপক ও সমাজসেবকও ছিলেন। নিরাভরণ সাদামাটা জীবনের অধিকারী শেখ রোকন উদ্দিন নিজের সাহস, নেতৃত্বের দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের দ্যুতিতে খুলনাবাসীর হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে নেন।

আরও পড়ুন: সততা ও পেশাদারিত্বের পুরস্কার পেলেন নতুন সেনাপ্রধান এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ

১৯৮০ সালে মাটির শীতল বিছানায় চির ঘুমে শায়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভোটে নির্বাচিত হয়ে টানা দুই যুগ একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন খুলনাবাসীর কল্যাণে বিভিন্ন জনহিতকর কর্মকান্ডেও। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে খুলনাবাসী ‘প্রফেসর রোকন উদ্দিন সড়ক’ নামে একটি সড়কের নামকরণ করেন।

সততা ও দায়িত্বশীলতায় নজির স্থাপন করা, স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ নিজের সুদক্ষ নেতৃত্ব, মেধা, সৃজনশীলতা, সাহস ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আধুনিক, প্রযুক্তি জ্ঞান-সম্পন্ন আন্তর্জাতিকমানের একটি শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীতে রূপান্তরে কাজ করার সুদৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

তিনি বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে সবার সহযোগিতায় আমি বাংলাদেশ সরকারের আমার ওপর অর্পিত গুরুদায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে সক্ষম হবো।’

আরও পড়ুন: অভিনন্দনের জোয়ারে নতুন সেনাপ্রধান এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ

নতুন সেনাপ্রধানের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার
জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ২৩ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি হতে নবম দীর্ঘ মেয়াদি কোর্সের সাথে কমিশন লাভ করেন। কমিশন পরবর্তী তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশন এলাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান পূর্বক তাঁর সামরিক কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এ্যান্ড ষ্টাফ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাষ্টারস্ ইন ডিফেন্স ষ্টাডিজ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) হতে ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড সিকিউরিটি ষ্টাডিজ -এ প্রথম বিভাগে অসামান্য ফলাফলসহ এমফিল সম্পন্ন করেন।

বর্তমানে তিনি বিইউপি এর অধীনে পিএইচডি সম্পন্নের উদ্দেশ্যে অধ্যায়নরত আছেন। জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ এমআইএসটি গোল্ড মেডেল অর্জনসহ প্রথম স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২০১০ সালে সফলতার সাথে চীনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি (এনডিইউ) হতে ডিফেন্স এ্যান্ড ষ্ট্র্যাটেজিক ষ্টাডিজ কোর্স এবং মিরপুর ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ হতে আর্মি স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি তিনি ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে North East South Asia (NESA) Centre কর্তৃক পরিচালিত এক্সিকিউটিভ সেমিনার কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং NESA এর গ্রাজুয়েট হিসেবে সম্মানিত হন।

আরও পড়ুন: জেনারেল র‍্যাংক ব্যাজ পরানো হলো নতুন সেনাপ্রধানকে

তাঁর বর্ণাঢ্য চাকুরি জীবনে তিনি জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) হিসেবে আর্মি ট্রেনিং এন্ড ডকট্রিন কমান্ড, ১৯ পদাতিক ডিভিশন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একমাত্র লজিষ্টিকস ফরমেশন কমান্ড করেন। এছাড়াও তিনি একটি পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশন এলাকায় একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে কমান্ড নিযুক্তিতে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ইনষ্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ষ্টাডিজ (বিআইআইএস) এর মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হতে একজন পাইওনিয়ার ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার হিসেবে ২০১৪-২০১৬ পর্যন্ত ইউনাইটেড ন্যাশনস্ মাল্টি ডাইমেনশনাল ইন্টিগ্রেটেড স্ট্যাবিলাইজেশন মিশন ইন দ্যা সেন্ট্রাল আফ্রিকাতে (মিনুস্কা) বহুজাতিক বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং অসামান্য কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের জন্য মিশন প্রধান স্পেশাল রিপ্রেজেন্টেটিভ অব দ্যা সেক্রেটারি জেনারেল (এসআরএসজি) কর্তৃক সাইটেশনপ্রাপ্ত হন।

এছাড়াও তিনি ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে মোজাম্বিকে শান্তিরক্ষা মিশনে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিভিন্ন ফরমেশন সদর দপ্তরে সিনিয়র অপারেশনাল এবং প্রশাসনিক ষ্টাফ অফিসারসহ সিনিয়র ডাইরেক্টিং স্টাফ হিসেবে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, প্রশিক্ষক হিসেবে ক্যাডেট কলেজ ও প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সদর দপ্তর আর্মি ট্রেনিং এ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ড (আর্টডক) এর চিফ অব ডকট্রিন ডিভিশন এবং সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে সামরিক প্রশিক্ষণ পরিদপ্তরের পরিচালক হিসেবে অত্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি সেনাসদরে কোয়ার্টার মাষ্টার জেনারেল (কিউএমজি) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ ও বেগম নুরজাহান আহমেদ দম্পতি দুই কন্যা সন্তানের গর্বিত বাবা-মা।

কালের আলো/ডিআরবি/এমএম