যোগাযোগে নতুন দিগন্ত, দৃশ্যমান হচ্ছে মেট্রোরেল

প্রকাশিতঃ 2:22 pm | July 01, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

অতিমারী করোনার মধ্যেও দেশের প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণের কাজ করছেন শ্রমিকেরা। দিন-রাত এক করে কাজ করে চলেছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিরপুর-মতিঝিল রুটকে যানজটমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের জুনে মেট্রোরেল চালু করা সম্ভব হবে। পুরো প্রকল্পটি চালু হলে মাত্র ৩৫ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছানো যাবে। দিনে যাত্রী পরিবহন করতে পারবে ৫ লাখের কাছাকাছি।

জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার মেট্রোরেল চালুর চেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয়ই রয়েই গেছে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে কাজের গতিতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটলেও এখন পুরোদমে কাজ চলছে। আগামী মাসের কাজের অগ্রগতি থেকে বোঝা যাবে, ১২ কিলোমিটার ডিসেম্বরে চালু করা যাবে কিনা?

মেট্রোরেল নির্মাণ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সব স্থানেই কাজ চলছে। আর মেট্রোরেলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন নগরবাসী। ছুটির দিন এবং অন্যান্য দিনে পরিবার-পরিজন নিয়ে মেট্রোরেলের এই মহাযজ্ঞ দেখতে আসছেন অনেকেই। অনেক জায়গায় শুধু পিলার দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও স্থাপন করা হয়েছে ভায়াডাক্ট (দুই পিলারকে সংযোগকারী কংক্রিটের স্থাপনা), কোথাও স্টেশন নির্মাণের কাজ, আবার কোথাও পুরোপুরি নির্মিত হয়েছে লাইনের কাজ।

মাটি থেকে ১৩ মিটার ওপরের এই সড়কে উঠলেই বোঝা যাবে এটি কোনো ফ্লাইওভার বা উড়াল সড়ক নয়, এটি দেশের প্রথম মেট্রোরেল। ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের ১৪ দশমিক ৪৯ কিলোমিটারের ভায়াডাক্ট স্থাপন ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীর মূল ডিপো থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার চালুর জন্য চলছে জোর প্রস্তুতি।

এর মধ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কে বসছে রেলওয়ে স্ল্যাব। দিয়াবাড়ী থেকে মিরপুর ডিওএইচএস পর্যন্ত রেলওয়ে স্লিপার ও বৈদ্যুতিক লাইন বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মিরপুর পল্লবী পর্যন্ত স্টেশন স্থাপনের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে এসে পৌঁছেছে দুই সেট মেট্রোরেলের কোচ।

কাজের অগ্রগতির বিষয়ে প্রকৌশলী এস এম শাহীন বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে কাজের গতি কিছুটা কম থাকলেও এখন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ চলছে। মেট্রোরেলের পঞ্চম স্টেশন পর্যন্ত স্লিপারের কাজ শেষ হয়েছে। বৈদ্যুতিক খুঁটিও বসানো হয়েছে। রেলের ডিপোর বিভিন্ন ভবনের কাজও সম্পন্ন। এখন চলছে সজ্জার কাজ। এছাড়া প্রথম ও দ্বিতীয় স্টেশনের কাজও শেষ পর্যায়ে। এখন ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক্যাল সিস্টেম, টাইলসের কাজ চলছে। উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ ও পল্লবী স্টেশনের কনকোর্স ছাদ এবং প্ল্যাটফর্ম নির্মাণের কাজ শেষ।

‘বাকি পাঁচ স্টেশন মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও স্টেশনের কনকোর্স ছাদ ও প্ল্যাটফর্ম নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। কাজিপাড়া ৭ নম্বর স্টেশন, শেওড়াপাড়া ৮ নম্বর ও আগারাগাঁও ৯ নম্বর স্টেশনের কাজ কিছুটা ধীরগতিতে চলছে। এসব স্টেশনের এখন ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে।’

আগারাগাঁও স্টেশনে কর্মরত প্রকৌশলী মো. সোহাগ বলেন, মিরপুর ১০ থেকে আগারাগাঁও পর্যন্ত কাজের গতি একটু কম। ব্যস্ততম সড়ক হওয়ায় দিনে কাজ করতে সমস্যা হয়। তবে রাতে পুরোদমে কাজ চলে। এখন স্টেশনের ছাদের কাজ চলেছে। এখন পর্যন্ত ৩০-৪০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের যে ৬৪ শতাংশ কাজ হয়েছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ৮৫ শতাংশ। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের পূর্তকাজ হয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। পাশাপাশি ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক্যাল সিস্টেম ও রোলিং স্টক ও ডিপোর ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি প্রায় ৫৫ শতাংশ।

আর প্যাকেজ-১-এর আওতায় ডিপো এলাকায় ভূমি উন্নয়ন কাজ শুরু হয় গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে। নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হওয়ায় সরকারের ৭০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে।

ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় গতি আনতে মেট্রোরেল করার চিন্তাভাবনা শুরু হয় গত শতকের শেষ দিক থেকেই। কিন্তু নানা জটিলতায় সেই চিন্তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এ নিয়ে সমীক্ষা শুরু হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রাজধানীজুড়ে ‘বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট’ (বিআরটি) ও মেট্রোরেল নির্মাণ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রথম পর্যায়ে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার উড়ালপথে এ রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ জন্য ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা জাপানের আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকা ও ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা স্থানীয়ভাবে জোগানের সিদ্ধান্ত হয়।

কিন্তু নকশা জটিলতার কারণে প্রকল্পটি আটকে ছিল। নকশা সংশোধন শেষে ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এটির অনুমোদন দেয়। ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত।

নকশা অনুযায়ী, মেট্রোরেল মাটি থেকে ১৩ মিটার ওপরে স্থাপিত। যাত্রী ওঠানামার জন্য থাকবে ১৬টি স্টেশন। এগুলো হচ্ছে উত্তরা উত্তর, উত্তরা মধ্য, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয় ও মতিঝিল। তিন তলাবিশিষ্ট স্টেশনের দ্বিতীয় তলায় থাকছে টিকিট কাউন্টার এবং অন্য সুবিধাদি। প্ল্যাটফর্ম থাকবে তৃতীয় তলায়।

স্টেশনগুলোতে ওঠার জন্য সাধারণ সিঁড়ির পাশাপাশি থাকবে লিফট ও চলন্ত সিঁড়ি। টিকিট দিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের ব্যবস্থা হবে স্বয়ংক্রিয়। নিরাপত্তার জন্য স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নিরাপত্তা বেষ্টনী বা প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর স্থাপন করা হবে।

জানা যায়, প্রথমে এটি আগারগাঁও হয়ে বিজয় সরণি থেকে মতিঝিল যাওয়ার কথা ছিল। পরে নকশায় সংশোধন এনে খামারবাড়ি হয়ে মতিঝিল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির নামে পরিচালিত এই প্রকল্পটি কাজের সুবিধার্থে ৬ ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম দিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০২১ সালে পুরো প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু কাজের তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় সেই অবস্থান থেকে সরে আসে সরকার। ২০২১ সালের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে সিপি-১ থেকে সিপি-৪ অর্থাৎ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এ অংশে স্টেশন সংখ্যা ৯টি। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অর্থাৎ সিপি-৫ ও সিপি-৬ অংশের কাজ ২০২৪ সালের মধ্যে শেষের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পুরো প্রকল্পটি চালু হলে মাত্র ৩৫ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছানো যাবে। দিনে যাত্রী পরিবহন করতে পারবে ৫ লাখের কাছাকাছি।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক জানান, দেশের প্রথম মেট্রোরেল আগামী বছরের জুনে চালু হবে। এ সময় রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশের মধ্যে উত্তরা-আগারগাঁও অংশে মেট্রোরেল চলাচল করবে।

করোনায় নির্মাণ কাজ চলার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি ও সব সরকারি নির্দেশনা মেনে কাজ করছি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মানতে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন মেগা প্রকল্পেও নির্দেশনাগুলো মানতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

‘শ্রমিকদের জন্য প্রকল্প এলাকায় তৈরি করা হয়েছে আইসোলেশন সেন্টার। তাপমাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে,’ যোগ করেন ডিএমটিসিএল এর এমডি।

প্রকল্পের অগ্রগতি বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে প্রায় ৬৪ দশমিক ৯১ শতাংশ। জাপান থেকে ডিপো এলাকা দিয়াবাড়ীতে এসেছে একাধিক ট্রেন সেট। এগুলোর পরীক্ষামূলক চলাচলের জন্য ১৯ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে।

‘উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। তার মধ্যে ১৪ দশমিক ৪১ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (উড়ালপথ) স্থাপন শেষ করা হয়েছে। উত্তরা-আগারগাঁও অংশের অগ্রগতি ৮৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের অগ্রগতি ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ,’ বলেন প্রকৌশলী এমএ এন সিদ্দিক।

কালের আলো/এমএ/বিআরবিএ