নতুন অর্থবছরের শুরুতেই লকডাউনের ‘খড়গ’

প্রকাশিতঃ 7:01 pm | July 02, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:

শুরু হলো ২০২১-২১ অর্থবছর। নতুন অর্থবছরের প্রথম ধাক্কা কঠোর লকডাউন। এ অবস্থায় গেল অর্থবছরের মতো এবারও করোনার থাবা পড়েছে শুরুতেই। এক্ষেত্রে আরও গোছালো ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়নের পক্ষে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা যায়, সরকারি হিসাবে করোনা মহামারিতে আর্থিক ক্ষতি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫শ কোটি টাকা (১৭শ কোটি মার্কিন ডলার)। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে দেশের অর্থনীতির ওপর লকডাউনের কালো ছায়ায় কীভাবে গ্রাস করেছে। যা এখনো অব্যাহত। ২০২০ সালের মার্চে শুরু হওয়া করোনার পর এখনও পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি ফেরেনি।

রীতিমতো স্থবির পর্যটন খাত। কম সক্ষমতা নিয়ে ধুঁকছে কয়েক লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। অবস্থা ভালো নয় সরকারের রাজস্ব কোষেরও। আর চাকরিচ্যুতসহ নানা কারণে কমছে মানুষের আয়। পাশাপাশি দারিদ্র্যের শিকার কয়েক কোটি মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে আজ শুরু হয়েছে নতুন অর্থবছর ২০২১-২২।

অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে ভবিষ্যতে প্রধান চ্যালেঞ্জই হবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা।

উল্লখ্য, গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পাশ হয়েছে। যা কার্যকর হয় ১ জুলাই। তবে শুরুর প্রথম দিনেই অর্থনীতি এক ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দেশব্যাপী চলছে সপ্তাহব্যাপী কঠোর লকডাউন।

এতে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ আছে। এছাড়া সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব ধরনের যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে। বন্ধ আছে শপিংমল, মার্কেটসহ সব দোকানপাট, পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র। স্থবিরতা নেমে আসছে পুরো অর্থনীতি অঙ্গনে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ছোট-বড় সব ধরনের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, হোটেল, চায়ের দোকানি, মুদি দোকান, মনোহারি দোকানি আছে প্রায় ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৯৪ জন। এর মধ্যে গ্রামে অবস্থান হচ্ছে ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯২০ জন।

আর শহরে অবস্থান ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৭৪টি। এদের মধ্যে ফেরিওয়ালা, হকার ও ভ্যানে পণ্য বিক্রেতা আছেন ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৭১৯ জন, চা-পান বিক্রেতা আছেন ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৮৫ জন। সবাই এই লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া নির্মাণ খাতে জড়িত আছে ৩৪ লাখ লোক এবং পরিবহন খাতে আছে ৫২ লাখ শ্রমিক। এসব খাতের লোকজন কর্মহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি রেজাউল ইসলাম মন্টু বলেন, গত এক বছর ধরে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো প্রণোদনা পাচ্ছে না এসব উদ্যোক্তা। বলা হচ্ছে জীবন বাঁচাতে হবে। পাশাপাশি জীবিকার জন্য ব্যবস্থা ও অবস্থান জানা নেই আমাদের।

তিনি বলেন, শপিংমল, দোকানপাট বন্ধ থাকায় এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আরও অবস্থা খারাপ হবে।

এদিকে সরকারি অফিস বন্ধ থাকায় মাঠ পর্যায়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ আছে। এতে চলতি অর্থবছরের শুরুতে এক সপ্তাহের অর্থনীতি কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতি দাঁড়াবে ৬৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এ বছর নতুন জিডিপি ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ টাকা থেকে সম্ভাব্য এ ক্ষতির ধারণা করা হচ্ছে। তবে লকডাউনের সময়সীমা আগামীতে বাড়লে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।

অর্থনীতির এ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ২৯ জুন জাতীয় সংসদে বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, সারাবিশ্বের অর্থনীতি পাল্টে গেছে, লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বিশ্বে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন এমন করুণ, সে অবস্থায়ও বাংলাদেশের অর্থনীতি ততটা খারাপ হয়নি।

তিনি বলেন, সারাবিশ্বই করোনার কারণে ঘাটতি বাজেট প্রণয়নের পথ বেছে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এ বছর বাজেট ঘাটতি নির্ধারণ করেছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তবে সারাবিশ্বে অর্থনীতিতে ঘাটতি বাজেটের হার ৪১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতি সচল রাখাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। সচলের প্রধান উপকরণ হচ্ছে ভ্যাকসিন। দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।

‘ভোক্তা ব্যয় করতে না পারলে রাজস্ব আহরণ হবে না। লকডাউনে ভোক্তা ব্যয় করতে পারবে না। এতে রাজস্ব অর্জন কঠিন হবে। পাশাপাশি সরকারি অফিস বন্ধ থাকলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ধাক্কা খাবে। ফলে আগামী অর্থবছর এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ও অনিশ্চয়তার মধ্যেই কাটবে।’

এদিকে নতুন বছরে বড় আরও একটি চ্যালেঞ্জ রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। এ বছর ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বইছে। নতুন করে অভিঘাতের মুখে পড়ছে ক্ষুদ্র, কুটির, ছোট ও মাঝারি আকারের শিল্প। ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা। ফলে রাজস্ব আহরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

এ নিয়ে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি এক বিবৃতিতে বলা হয়, কোভিড-১৯ বিপর্যয় থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে টেকসই করতে দুটি বিষয় জরুরি। এর একটি হচ্ছে রাজস্ব আহরণ এবং অপরটি প্রণোদনা প্যাকেজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন। তবে উভয় ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আসতে পারে বলে সেই পূর্বাভাসে বলা হয়।

এতে আরও বলা হয়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অর্থনীতির উৎপাদনশীল খাতে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

করোনার মধ্যেও বিশ্ববাজারে টানা বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম। নিত্যপণ্যটির দাম বেড়ে গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) জ্বালানি তেলের ভবিষ্যৎ সরবরাহ মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৬২ সেন্ট বা দশমিক ৭০ শতাংশ বেড়ে ৭০ দশমিক ৯১ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়।

অন্যদিকে ইউরোপের বাজারে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম গত সপ্তাহে ১ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল ৭২ দশমিক ৬৯ ডলারে উঠেছে। এই মূল্য বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে। আর সেটি হলে বাড়বে নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের শিল্পপণ্যের দাম। যা ভোক্তার ব্যয় বেড়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হবে।

লকডাউনে একটি স্বস্তির খবর রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছে। এতে এসব শিল্প উদ্যোক্তা তাদের উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে।

এ বিষয়ে বিকেএমইএ—এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. হাতেম বলেন, লকডাউন দিয়ে নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন মানেই হচ্ছে একটি বিষাদ দিন।

সরকার সুযোগ করে দেওয়ায় আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা থাকছে। শিল্প খোলা না থাকলে শ্রমিকরা গ্রামে যাবে। অবাধ চলাফেরায় করোনায় আক্রান্ত সংকট আরও বাড়বে। আমরা প্রমাণ করেছি শিল্প চালু থাকলে শ্রমিকরা নিরাপদ থাকবে।

তবে অনেক ছোট শিল্প উদ্যোক্তা এই সঙ্কটে  হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

কালের আলো/ডিএসবি/এমএম