মোংলা বন্দরে রাজস্ব আয়ে রেকর্ড
প্রকাশিতঃ 10:38 am | July 07, 2021

কালের আলো সংবাদদাতা:
দেশের দ্বিতীয় সামুদ্রিক বন্দর মোংলায় একদিকে যেমন বাণিজ্যিক জাহাজের আগমন বেড়েছে অন্যদিকে বেড়েছে রাজস্ব আয়। করোনাকালীন দেশের অন্যান্য বন্দরের কার্যক্রম কিছুটা স্থবির থাকলেও মোংলা বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টাই সচল রাখা হয়েছে। করোনা সংকটের মধ্যেও সদ্যবিদায়ী বছরে জাহাজ আগমনে ৭০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে বন্দরটি। রাজস্ব আয়েও পেয়েছে সাফল্য।
বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পরিচালিত হয়েছে বন্দরের কার্যক্রম, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। সারাদেশে করোনার সংক্রমণ থাকলেও বন্দরের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য কোনো প্রভাবই পড়েনি।
বন্দর সূত্র মতে, অব্যবস্থাপনা আর উদাসীনতায় সম্ভাবনাময় বন্দরটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। মোংলা বন্দর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর। এটি খুলনা শহর থেকে ৪৪ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার শেহলাবুনিয়া মৌজায় পশুর নদী ও মোংলা নদীর সংযোগস্থলে খুলনা-বাগেরহাট সীমান্তে ভৌগোলিকভাবে অবস্থিত। এটি পশুর নদী ও মোংলা নদীর বঙ্গোপসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ১৯৫০ সালের ১ ডিসেম্বর বন্দরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ওইদিন একটি ব্রিটিশ বণিক জাহাজ বন্দরে প্রথম নোঙ্গর করে। পরবর্তীতে সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচলের উপযোগী গভীরতা হারিয়ে ফেলায় পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে ১৯৮০ সাল থেকে বন্দরটি প্রায়ই বন্ধ থাকতো এবং মাঝে মধ্যে খননের পর জাহাজ নোঙরের জন্য উন্মুক্ত করা হতো।
সূত্র আরও জানায়, বিগত ২০০১ থেকে ২০০৮ অর্থবছর পর্যন্ত মোংলা বন্দর নানামুখী প্রতিকূলতার কারণে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। ২০০৭-০৮ অড়২র্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সাতটি জাহাজ ও পূর্ণ অর্থবছরে মোট ৯৫টি জাহাজ আগমন করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মোংলা বন্দরের উন্নয়নে সরকার অগ্রাধিকার ও বিশেষ গুরুত্ব দেন। বিশ্বের আধুনিক বন্দরগুলোর আদলে শুরু হয় উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের কাজ। ক্রমান্বয়ে মোংলা বন্দর গতিশীল হয়ে ওঠায় প্রতি বছর বিদেশি জাহাজের আগমনে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
করোনা সংকটে সবকিছু স্থবির হলেও অর্থনীতি সচল রাখতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে কার্যক্রম সচল করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসার প্রশংসনীয় উদ্যোগ এবং কঠোর নির্দেশনায় করোনা সংকটেও ঝুঁকি নিয়েই মাঠে কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলশ্রুতিতে করোনা মহামারির মধ্যেই ৭০ বছরের নতুন রেকর্ড গড়েছে বন্দরটি। বিদায়ী অর্থবছর (২০২০-২১) মোংলা বন্দরে সর্বোচ্চ ৯৭০টি জাহাজ আগমনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টির পাশাপাশি এ সময়ে রেকর্ড পরিমাণ ১১৯ দশমিক ৪৫ লাখ টন পণ্য হ্যান্ডলিংও (ওঠানামা) খালাস করেছে। এ সময় রিকন্ডিশন গাড়ি এসেছে ১৪ হাজার ৪৪৭টি, যা থেকে মোংলা বন্দর রেকর্ড পরিমাণ ৩৪০ কোটি টাকা আয় করেছে। একই সময়ে ব্যয় হয়েছে ২১০ কোটি টাকা। নিট মুনাফা হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। এটি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৯ কোটি টাকা বেশি। আয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে গৃহহীনদের ঘর প্রদানের জন্য সম্প্রতি পাঁচ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সাফল্য ধরাকে চালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৬০ কোটি টাকা আয়, জাহাজ আগমন এক হাজারেরও বেশি ও নিট মুনাফা ১৫০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ।
তথ্য মতে, বিশ্বের প্রায় সকল প্রধান বন্দরের সাথে মোংলা বন্দরের সংযোগ রয়েছে, তবে এখানে বেশির ভাগ জাহাজ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকে আসে। মাঝে মাঝে কিছু জাহাজ লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আসে। শতশত জাহাজ প্রতি বছর এই বন্দর ব্যবহার করে, যেগুলোর বেশির ভাগ সিঙ্গাপুর, হংকং এবং কলম্বো দিয়ে আসে। ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দরসহ বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদীবন্দরকে এটি সংযুক্ত করেছে। ভারতের সাথে একটি উপকূলীয় জাহাজ চুক্তির মাধ্যমে, মোংলা প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের সাথে জাহাজ রুটে সরাসরি কলকাতা বন্দরকে সংযোগ করেছে। থাইল্যান্ডের সাথেও একটি উপকূলীয় জাহাজ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
বর্তমানে বন্দরটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে, পণ্য খালাসের জন্য ২২৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করতে পারে। নোঙরের জন্য একটি বাধ্যতামূলক খোলামেলা দীর্ঘ চ্যানেল রয়েছে এবং উভয় পার্শ্বে ৩৩টি জাহাজ একই সাথে পণ্য খালাস বা বোঝাই করতে পারে। ১১টি জেটি, পণ্য বোঝাই ও খালাসের জন্য সাতটি শেড এবং আটটি ওয়্যারহাউজ রয়েছে। নদীর গভীরে রয়েছে ১২টি ভাসমান নোঙরস্থান। হিরণ পয়েন্টে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ নাবিকদের জন্য একটি রেস্ট হাউজ নির্মাণ করেছে।
বন্দর সূত্র আরও জানায়, পদ্মা সেতু, রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, খানজাহান আলী বিমানবন্দর, রেললাইন ও পশুর চ্যানেলের ইনার বারের খননসহ মোংলা বন্দরের চলমান ৯টি মেগাপ্রকল্প চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে আউটার বারের খননকাজ সম্পন্ন হওয়ায় বড় বড় জাহাজ সরাসরি চ্যানেলে অবস্থান ও জেটিতে ভিড়তে পারছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলেও বন্দরের ব্যবহার আরও বেড়ে যাবে। সারা দেশের সঙ্গে সরাসরি সড়ক ও নৌপথে যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে আঞ্চলিক বাণিজ্যিক পণ্য আদান-প্রদানে প্রাধান্য পাবে বন্দরটি। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আধুনিকায়নসহ নানা উন্নয়নকাজ চলছে মোংলাজুড়ে। বন্দর ব্যবহারকারীদের সেবায় আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত, পোর্টভিত্তিক শিল্পের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, বিশ্ব বাণিজ্য আলোকে বন্দরের আধুনিকায়ন, কাজের সুযোগ সৃষ্টি করাসহ নানা বিষয় প্রাধান্য দিয়ে চলছে কাজ।
জানতে চাইলে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, বন্দর ঘিরে আগামী দিনের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আধুনিকায়নসহ উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে কাজ বিলম্বিত হয়েছে, এরপরও আমরা শেষ করার চেষ্টা করছি। এসব কাজ শেষ হলে বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং চলতি অর্থবছরের যে লক্ষ্যামাত্রা নেয়া হয়েছে, সেটা অর্জিত হবে ইনশাল্লাহ।
কালের আলো/এসবি/এমএইচএ